
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আসন্ন নির্বাচনের উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছে। ঠিক এমন সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অভিযোগ করেছেন, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা রোধে নানা ধরনের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি দাবি করেন, বিএনপি একটি সুসংগঠিত পরিকল্পনা নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, কিন্তু সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ করার জন্য ভেতরে-বাইরে নানা মহল সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
সোমবার বিকেলে নওগাঁ জেলা বিএনপির দীর্ঘ ১৫ বছর পর আয়োজিত দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তারেক রহমান। নওগাঁ শহরের বালুডাঙ্গা এলাকায় নওগাঁ কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে জেলার ১১টি উপজেলা ও তিনটি পৌর কমিটির ১ হাজার ৪১৪ জন কাউন্সিলর অংশ নেন। বিকাল সাড়ে ৫টা থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় অধিবেশনে কাউন্সিল ভোটের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। শীর্ষ তিন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট ২০ জন প্রার্থী।
তারেক রহমান বলেন, “স্বৈরাচারের পতনের পর গণঅভ্যুত্থানের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে। এখন আমরা দ্বিতীয় পর্বে প্রবেশ করেছি—এটি জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন।” তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে, রোজার আগে, নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই নির্বাচন যাতে না হয়, সেজন্য বিভিন্ন জায়গায় নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে।
তিনি নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বলেন, “এখন বিএনপির সুসময় চলছে। এই সময় অনেক ‘ঘুঘু’ কাছে আসবে—যারা সুযোগসন্ধানী, ব্যক্তিস্বার্থে দলকে ব্যবহার করতে চাইবে। এই ঘুঘুদের সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। একই সঙ্গে দলের ভেতরে ঐক্য অটুট রাখতে হবে, কারণ বিভক্ত হলে ষড়যন্ত্রকারীরা লাভবান হবে।”
তারেক রহমান স্পষ্ট করে দেন, শুধু ক্ষমতায় যাওয়া বিএনপির চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়—বরং ক্ষমতায় গিয়ে দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি, কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করাই আসল চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, “দেশে বহু বেকার আছে, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে প্রথম কাজ। কৃষি খাতের উন্নয়ন, শিক্ষার মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবার বিস্তার—সব ক্ষেত্রেই এখন ভঙ্গুর অবস্থা। বিএনপি ইতোমধ্যে এসব মোকাবিলায় বিস্তারিত পরিকল্পনা করেছে।”
তারেকের মতে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ঠেকাতে ক্ষমতাসীন ও তাদের সহযোগী মহল বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। “আমাদের কাজ হবে এই ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে জনগণের আস্থা অর্জন করা,” বলেন তিনি।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “দেশের মানুষ এখন বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। তারা বিশ্বাস করে, এ দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে পারবে শুধু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। আপনাদের আচরণ, কথা ও কর্মকাণ্ডে সেই আস্থার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। মাঠে-ময়দানে, মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকতে হবে।”
সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন নওগাঁ জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক এসএম রেজাউল ইসলাম। প্রধান বক্তা ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ। তিনি বলেন, “যে চক্রান্ত চলছে, তা রুখতে সংগঠনকে তৃণমূল থেকে শক্তিশালী করতে হবে। আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”
এ ছাড়া বক্তব্য দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাজশাহী বিভাগীয় বিএনপির সমন্বয়কারী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম, উপদেষ্টা লে. কর্নেল (অব.) আব্দুল লতিফ খান, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগ) সৈয়দ শাহীন শওকত, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুর রহমান খান আলীম এবং ওবায়দুর রহমান চন্দন প্রমুখ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আবদুল হালিম মনে করেন, তারেক রহমানের বক্তব্য মূলত দুইটি বার্তা দেয়—একটি হলো অভ্যন্তরীণ ঐক্য বজায় রাখার তাগিদ, আরেকটি হলো নির্বাচনের আগে-বরে সম্ভাব্য রাজনৈতিক চক্রান্ত মোকাবিলার প্রস্তুতি। “তিনি সুযোগসন্ধানী নেতাকর্মীদের নিয়ে যেভাবে সতর্ক করেছেন, তা ইঙ্গিত দেয় যে বিএনপির ভেতরে আস্থার সংকট বা ভিন্নমতও থাকতে পারে,” বলেন তিনি।
আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, “বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়, বরং নির্বাচনের পর রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্গঠন ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা। তারেক রহমান যেসব খাতের কথা বলেছেন—বেকারত্ব, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—এসব ক্ষেত্রের বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ থাকলে জনগণের আস্থা বাড়বে।”
নওগাঁ জেলা বিএনপির এই সম্মেলন, দীর্ঘ বিরতির পর হওয়ায়, স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস তৈরি করেছে। তবে জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের সতর্কবার্তা ইঙ্গিত দিচ্ছে—আগামী দিনের রাজনৈতিক লড়াই হবে কঠিন ও বহুস্তরীয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ