
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর কাঠামোগত সংস্কার এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত "এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ" তাদের চার দফা যৌক্তিক দাবিতে অনড় রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে ২২ মে, ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির প্রতিক্রিয়ায় ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে আজ আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রদান করা হয়েছে। পরিষদ জানায়, যদিও কিছু অগ্রগতি হয়েছে, তবুও দাবি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনও গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি রয়ে গেছে।
গত ২০ ও ২১ মে তারিখে অর্থ উপদেষ্টা এবং মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর দু’টি পৃথক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের দাবিগুলোর যৌক্তিকতা আংশিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। বিশেষ করে, ২০২৫ সালের ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’-এর আলোকে গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি পরিষদ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। তবে পরিষদের ভাষ্য মতে, এই বিবৃতিগুলোতে চারটি মৌলিক দাবির বিষয়ে নির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট ও কার্যকর কোনো প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়নি।
দাবিসমূহ:
১. অবিলম্বে বিতর্কিত অধ্যাদেশ বাতিল করা: এনবিআরের স্বাধীন ও কার্যকর কাঠামো গঠনের পরিবর্তে যেভাবে অধ্যাদেশটি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। পরিষদ দাবি করে, এটি অবিলম্বে বাতিল করে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২. জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পদায়নকৃত চৌধুরী রকমত আলীকে অপসারণ: পরিষদ অভিযোগ করেছে, এনবিআরের গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন অনভিজ্ঞ ও রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে রাজস্ব ব্যবস্থায় পক্ষপাত সৃষ্টি করা হয়েছে। তাকে অপসারণের দাবি জানানো হয়েছে।
৩. সংস্কার প্রক্রিয়াকে জনসম্পৃক্ত করার আহ্বান: এনবিআর সংস্কার বিষয়ের খসড়া প্রণয়ন ও পর্যালোচনার জন্য গঠিত প্রম্পট কমিটিতে সাধারণ নাগরিক, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম প্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের মতামত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৪. প্রস্তাবিত কাঠামোগত সংস্কারে পূর্ণ স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ: ভবিষ্যতে রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, তাতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এনবিআর যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ, জবাবদিহিমূলক এবং প্রযুক্তিনির্ভর এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে, সেটাই মূল লক্ষ্য।
প্রেস বিজ্ঞপ্তির প্রতিক্রিয়ায় পরিষদের মতামত:
ঐক্য পরিষদ বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয় যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, তা কেবল একটি প্রাথমিক স্বীকৃতি হিসেবে ধরা যায়। যদিও এতে অধ্যাদেশটির বাস্তবায়নে কিছু ‘অবকাঠামোগত উদ্যোগ’ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু চারটি দাবির বিষয়ে এখনো সরকারিভাবে কোনো চূড়ান্ত ঘোষণা আসেনি। বিশেষ করে অধ্যাদেশটি প্রত্যাহারের কথা না বলা, চৌধুরী রকমত আলীর অপসারণে অনীহা, এবং জনসম্পৃক্ত সংস্কার কমিটি গঠনে অনিশ্চয়তা পরিষদকে হতাশ করেছে।
ঐক্য পরিষদ মনে করে, “রাজস্ব ব্যবস্থার টেকসই সংস্কার” কেবল দপ্তরীয় সিদ্ধান্তে সম্ভব নয়। বরং এটি একটি গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় হতে হবে যেখানে সব পক্ষের মতামত গুরুত্ব পাবে। পরিষদ অভিযোগ করে, এনবিআর-কে একটি স্বাধীন, বিশেষায়িত এবং দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার পরিবর্তে বরং কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে রাজস্ব আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি:
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কিছু ইতিবাচক অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ তাদের পূর্বঘোষিত ধারাবাহিক কর্মসূচি অনুসারে ২৪ মে, ২০২৫ (শনিবার) পর্যন্ত কলম বন্ধ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সময়কালে, সকল কর্মকর্তাকে কেবলমাত্র আবশ্যিক সরকারি দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে, তবে অন্যান্য সব ধরণের দাপ্তরিক কার্যক্রম স্থগিত থাকবে।
পরিষদ জানায়, এই কর্মসূচির কারণে সাধারণ সেবা গ্রহণকারীদের সাময়িক ভোগান্তি হলেও এটি বৃহত্তর স্বার্থে করা হচ্ছে। তারা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এটি তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ হিসেবে এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
ভবিষ্যত কর্মপন্থা:
পরিষদ তাদের বিবৃতিতে আরও জানিয়েছে যে, সরকার যদি চার দফা দাবির বিষয়ে চূড়ান্ত ও সুস্পষ্ট ঘোষণা না দেয়, তবে পরবর্তী সময়ে আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার পথ খোলা থাকবে। পাশাপাশি, তারা বারবার জোর দিয়ে বলেছে—তারা এনবিআরের টেকসই সংস্কার চায় এবং সেটি কোনো গোপন বা একতরফা সিদ্ধান্তে নয়, বরং সব পক্ষের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন হোক।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের এই দৃঢ় অবস্থান রাজস্ব ব্যবস্থার ভবিষ্যত কাঠামো নিয়ে নতুন করে ভাববার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সরকারের উচিত হবে দাবিগুলোর প্রতিটি বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে একটি অংশগ্রহণমূলক সংস্কার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, যাতে করে রাজস্ব ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ও কর্মচারীদের নৈতিক শক্তি দুই-ই বজায় থাকে।
বাংলাবার্তা/এসজে