
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জেলা ও উপজেলায় সরকারি ডিজিটাল ভূমি সেবা চালু হওয়ার পরও জনগণ এই সেবা থেকে স্বাচ্ছন্দ্য পাননি; বরং অনলাইন নামজারি ও ভূমি রেজিস্ট্রির প্রক্রিয়া তাদের জন্য যন্ত্রণার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সার্ভারের নিয়মিত ত্রুটি, কম্পিউটার অপারেটরের অদক্ষতা, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, এবং প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে জমি কেনাবেচা ও দলিল তৈরির কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সরকারের রাজস্ব আদায় এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
সরেজমিনে ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, ভূমি অফিসে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ দিনের পর দিন ঘুরে ফিরে ঘরে ফিরছেন, অথচ কাজের অগ্রগতি চোখে পড়ছে না। রাজধানীর গুলশান, বাড্ডা, তেজগাঁও ও আশপাশের ভূমি অফিসে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা সত্ত্বেও নামজারি সম্পন্ন হচ্ছে না। অনেকেই বাধ্য হয়ে দালালের শরণাপন্ন হচ্ছেন, ফলে সরকারি ফি থেকে কয়েক গুণ বেশি খরচ দিতে হচ্ছে।
সরকার ২০২০ সালে ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্প’ হাতে নিয়েছিল। প্রকল্পটির লক্ষ্য ছিল ভূমি ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত সেবাগুলো আধুনিক ও সহজলভ্য করা, এবং দেশের প্রধান সেবাগুলো অনলাইনে আনা। তবে পাঁচ বছর পরও প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল মেলেনি। সেবাপ্রার্থীরা অভিযোগ করছেন, অনলাইনে খতিয়ান পাওয়া যায় না, ফাইল সার্ভার থেকে হারিয়ে যায়, ভুল হলে তা সংশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে মাসের পর মাস আবেদন ঝুলে থাকে, যা তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেমন মেয়ের বিয়ে, জরুরি চিকিৎসা কিংবা বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
রাজধানীর বিভিন্ন ভূমি অফিস ঘুরে দেখা গেছে, এসি ল্যান্ড অফিসের কার্যক্রম ডিজিটাইজেশন করা হলেও রেজিস্ট্রার অফিসে কোনো আধুনিকায়ন হয়নি। ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার মুন্শী মোকলেছুর রহমান জানান, ‘রেজিস্ট্রার অফিসে কাজ সম্পন্ন করতে প্রয়োজন হয় কাগজপত্র যাচাই, যা ডিজিটাল সুবিধা না থাকায় খুব জটিল হয়ে পড়েছে। যদি এসি ল্যান্ড অফিসের ওয়েবসাইটের তথ্য আমাদের দেখার সুযোগ থাকত, তবে বিষয়টি সহজ হতো।’
ডিজিটাল যন্ত্রণা শুধু শহরে সীমিত নয়, গ্রামাঞ্চলেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা, যেমন সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ে মানুষ অনলাইন নামজারির জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করছেন। নুরুন্নবী ও জাহেদ হোসেনের মতো সেবাপ্রার্থীরা সার্ভারে ফাইল না থাকার কারণে পুনরায় আবেদন করতে বাধ্য হয়েছেন, ফলে অতিরিক্ত সময় ও খরচ পোহাতে হচ্ছে।
অনলাইন সেবার কারণে জমির লেনদেনও স্থবির হয়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রতিটি এসি ল্যান্ড অফিসে পুরনো সফটওয়্যারের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় প্রায় দেড় থেকে তিন হাজার পুরনো নামজারি, পরচা ও খাজনা পরিশোধের আবেদন মীমাংসা করা যাচ্ছে না। রূপগঞ্জ পূর্ব সাবরেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে এখানে মাত্র ৫১ লাখ ৬৯ হাজার ৯১০ টাকার খাজনা আদায় হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
মানুষের দীর্ঘ অপেক্ষার পরও সার্ভারের ভুল এবং ডিজিটাল ব্যবস্থার অপ্রস্তুতি সমস্যার মাত্রা বাড়াচ্ছে। তেজগাঁও ভূমি অফিসে দেখা গেছে, অনেকে দিনের পর দিন ঘুরেও কাজের অগ্রগতি পাচ্ছেন না। শাখাওয়াত নামের এক সেবাপ্রার্থী জানিয়েছেন, বনানীর দুটি ফ্ল্যাটের নামজারি করতে সরকারি ফি দুই হাজার ২০০ টাকা হলেও তাকে প্রায় ১৪ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। অন্যদিকে, সাইফুল নামের এক প্রার্থী পড়াশোনা করতে ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর জন্য জমি বিক্রির চেষ্টা করছেন, কিন্তু কাগজপত্র হালনাগাদ না হওয়ায় লেনদেন সম্ভব হচ্ছে না।
অদক্ষ কর্মীদের কারণে সমস্যার মাত্রা আরও বাড়ছে। রূপগঞ্জ ও সীতাকুণ্ডের ভূমি অফিসে দেখা গেছে, অনেক কর্মী প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজ করছেন। কায়েতপাড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কম্পিউটার অপারেটর জিসান জানান, ‘সার্ভার প্রায় সময়ই ডাউন থাকে, ফলে ভোগান্তির শেষ নেই।’ সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুনও স্বীকার করেছেন, ‘সার্ভারের সক্ষমতা মাত্র ৮০ শতাংশ হওয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের কেউ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়।’
ডিজিটাল নামজারি ও রেজিস্ট্রির কারণে ম্যানুয়াল পদ্ধতির তুলনায় কার্যক্রম মারাত্মকভাবে কমে গেছে। উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ম্যানুয়াল রেজিস্ট্রি হয়েছিল ১৩,৭৩৯টি, ই-রেজিস্ট্রি মাত্র ৪০২টি। ২০২৩ সালে ম্যানুয়াল ১৪,২৬৪টি, ই-রেজিস্ট্রি ৬৯১টি। ২০২৪ সালে ম্যানুয়াল ১২,৪১৪টি, ই-রেজিস্ট্রি ৫৪৯টি। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে ই-রেজিস্ট্রি বন্ধ আছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ পূর্ব সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দিনে ১৫০ থেকে ২০০টি দলিল হতো, এখন সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ৩০টি।
সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, ডিজিটালের সুবিধা পাওয়ার বদলে তারা আরও বেশি সমস্যায় পড়েছেন। নামজারির একটি ফাইল চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। সার্ভারে ফাইল না থাকায় আবার নতুন জটিলতা তৈরি হয়।
স্থানীয় কর্মকর্তাদের দাবি, ডিজিটাল ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হতে সময় লাগে এবং সম্পূর্ণ অনলাইন সচল না হওয়া পর্যন্ত ম্যানুয়াল সিস্টেম বন্ধ করা ঠিক হয়নি। কিন্তু সার্ভারের নিয়মিত ত্রুটি, তথ্য হারানো ও দালালদের মাধ্যমে ব্যয়বৃদ্ধি জনগণকে ডিজিটালের স্বপ্নের বদলে বাস্তব দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
ডিজিটাল নামজারি সমস্যার সমাধান দ্রুত করা না হলে শুধু সরকারি রাজস্বই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, দেশের ভূমি বাজার ও সাধারণ মানুষের জরুরি কাজও দীর্ঘ সময় স্থবির থাকবে। সরকারের ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের পরিচালক ও যুগ্ম সচিব পারভেজ হাসান জানিয়েছেন, নতুন দায়িত্বে আসার পর দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করছেন। তবে বাস্তবে সেবা সহজ হওয়া এবং ডিজিটাল ব্যবস্থার সঠিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে আরও কার্যকর নীতি, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও দালালদের সাথে সম্পর্ক এড়িয়ে চলাই এখন একমাত্র উপায়। সার্ভার ও সফটওয়্যার সক্ষমতা উন্নত করা, তথ্য একীভূতকরণ করা এবং পুরনো ম্যানুয়াল সিস্টেমের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করা ছাড়া ডিজিটাল নামজারি কার্যকরভাবে চালু করা সম্ভব হবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচও