
ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিস্থিতিতে চরম হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে স্পষ্টভাবে বলেছেন, চলমান অস্থিরতা ও নানামুখী চাপের মধ্যে দায়িত্ব পালন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে আর সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। এমনকি তিনি এমন প্রশ্নও তুলেছেন—যদি কাজই করতে না পারেন, তাহলে প্রধান উপদেষ্টার পদে থাকার প্রয়োজন কী?
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার এই হতাশা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থান নয়, বরং এটি গোটা অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকারিতা ও ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের জানিয়েছেন, একের পর এক প্রতিবন্ধকতা ও রাজনৈতিক অনৈক্যের কারণে সংস্কার কার্যক্রম এগোচ্ছে না, নির্বাচন আয়োজন নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা, এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকেও মিলছে না প্রত্যাশিত সহযোগিতা।
অনিশ্চয়তা ও চাপের মধ্য দিয়ে বৈঠকে বিস্ফোরণ
বৃহস্পতিবার (২২ মে) দুপুরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে এসব কথা বলেন অধ্যাপক ইউনূস। পরে বৈঠকের বাইরে অনির্ধারিত আলোচনায় তিনি তাঁর ক্ষোভ ও হতাশার বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেন। এই বৈঠকে উপস্থিত একাধিক উপদেষ্টা ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
সূত্রমতে, ওই আলোচনায় দেশের রাজনীতিতে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি, প্রতিদিন সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্থায়ী কোনো ঐকমত্য না থাকা এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রশাসনের নির্লিপ্ত ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। এসব প্রসঙ্গ টেনে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এই অবস্থায় সংস্কার করা সম্ভব নয়, নির্বাচনের আয়োজন করা সম্ভব নয়—তাহলে আমি থাকি কেন?”
তিনি আরও বলেন, “প্রতিদিন নানা দিক থেকে চাপ আসছে। এমনকি আমার নিজস্ব নীতিমালাও বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাহলে আমি কেন এই পদে থাকব?”
‘দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের’ পরোক্ষ ইঙ্গিত
বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন উপদেষ্টার বর্ণনায় জানা গেছে, আলোচনা এক পর্যায়ে এমন দিকে গড়ায় যেখানে অধ্যাপক ইউনূস সরাসরি বলেন, “আপনারা চাইলে নতুন করে আরেকটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে পারেন। আমি চলে যেতে প্রস্তুত।” তিনি আরও বলেন, “নির্বাচনের সময় যদি ব্যালট ছিনতাই, সহিংসতা বা জালিয়াতির মতো ঘটনা ঘটে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা সামাল দিতে পারবে কি না, সে নিয়েও আমার সন্দেহ রয়েছে। আর যদি ভালো নির্বাচন না হয়, তাহলে জনগণ আমাকে দায়ী করবে।”
এই আলোচনা থেকেই স্পষ্ট হয় যে, তিনি পদত্যাগের কথা সিরিয়াসলি ভাবছেন এবং নতুন নেতৃত্বের জন্য জায়গা করে দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
পদত্যাগ ভাবনায় ইউটার্ন ঠেকাতে তৎপর রাজনৈতিক নেতারা
বিকেলে ও সন্ধ্যায় অধ্যাপক ইউনূসের বাসভবন ‘যমুনা’-তে তাকে দেখতে যান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। বের হয়ে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “স্যার বলছেন, আমি যদি কাজ করতে না পারি, তাহলে এভাবে চলা যায় না। আমাকে তো গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে আনা হয়েছিল দেশকে পরিবর্তনের জন্য, কিন্তু এখন এমনভাবে আমাকে জিম্মি করা হচ্ছে যে আমি কাজ করতে পারছি না।”
নাহিদ ইসলাম আরও জানান, অধ্যাপক ইউনূস তাঁকে বলেছেন তিনি পদত্যাগের বিষয়টি বিবেচনা করছেন এবং মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
তবে নাহিদ ইসলাম তাঁকে এমন কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন, “আমি তাকে অনুরোধ করেছি যেন তিনি শক্ত থাকেন, কারণ এটি শুধু তার একক সংকট নয়, এটি জাতির ভবিষ্যতের প্রশ্ন। আমরা তাকে বলেছি, সব পক্ষের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তুলে সামনে এগোতে হবে।”
জাতির উদ্দেশে ভাষণের খসড়া প্রস্তুত, তবে সিদ্ধান্ত হয়নি
সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার কথা বিবেচনা করছেন। এ বিষয়ে একটি খসড়াও তৈরি হয়েছে। ভাষণে তিনি কাজ করতে না পারার কারণ, বিভিন্ন পক্ষের অসহযোগিতা, নির্বাচন আয়োজনের বাস্তবতা ও সংস্কারের অগ্রগতিহীনতা তুলে ধরবেন। তবে শেষ পর্যন্ত ভাষণ দেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি এবং এ নিয়ে পরবর্তী বৈঠকে আলোচনা হতে পারে।
সরকারের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত
এই পরিস্থিতি সামনে রেখে অনেকেই মনে করছেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ শুধু একটি প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়—এটি পুরো অন্তর্বর্তী সরকারের স্থায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি করতে পারে। যে সরকার গণ-আন্দোলনের পর জনগণের উচ্চ প্রত্যাশা নিয়ে গঠিত হয়েছিল, তা এখন কার্যত এক গভীর সংকটের মুখে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংকট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্রুততম সময়ে ঐকমত্য না হলে আরও গভীর হতে পারে এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়বে। এখন দেখার বিষয়, অধ্যাপক ইউনূস আদৌ পদত্যাগপত্র জমা দেন কি না, নাকি রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনুরোধে আরেকবার দায়িত্ব পালনের জন্য থেকে যান। যেটাই ঘটুক না কেন, দেশের রাজনীতিতে এটি একটি বড় বাঁক।
বাংলাবার্তা/এমএইচ