
ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চলতি সপ্তাহে আবারও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে যাচ্ছে। কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত রূপরেখা নির্ধারণ করা এবং তা কার্যকর করার পথ সুসংহত করা। এ ক্ষেত্রে শুধু আনুষ্ঠানিক বৈঠক নয়, বরং অনানুষ্ঠানিক সংলাপকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিগগিরই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গেও আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
কেবল আলোচনার জন্য নয়, কমিশন তাদের খসড়া সনদে ইতিমধ্যেই কিছু মৌলিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা রাজনৈতিক দলগুলোকে জানানো হয়েছে। তবে দলগুলোর প্রতিক্রিয়া মিশ্রভাবে এসেছে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি মৌলিক ইস্যুতে অনড় অবস্থান বজায় রেখেছে। বিশেষত সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি নিয়ে বিতর্ক তীব্র। বিএনপি চায়, আইনি ভিত্তি না দিয়ে নির্বাচিত সংসদ সংস্কারের খসড়া সনদ বাস্তবায়ন করবে। অন্যদিকে জামায়াত, ইসলামপন্থি দল এবং এনসিপি নির্বাচনের আগে আইনি ভিত্তি দিয়ে সনদ কার্যকর করতে চায়।
খসড়া সনদ ও দলগুলোর প্রতিক্রিয়া
জুলাই সনদে উল্লেখিত প্রধান প্রস্তাবগুলো হলো—
-
জাতীয় সাংবিধানিক কমিশন গঠন
-
সংসদের উচ্চ কক্ষে ভোটের আনুপাতিক হার নির্ধারণ
-
নির্বাচনের আগে বা পরে আইনি ভিত্তি তৈরি করা
বিএনপি প্রধানভাবে আপত্তি তুলেছে সংবিধানের উপর সনদকে স্থাপন করার এবং নির্বাচনের আগে আইনি ভিত্তি না দেয়ার ব্যাপারে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আগের সনদে নির্বাচিত সংসদ পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সনদ বাস্তবায়ন করবে বলা হয়েছিল। নতুন খসড়ায় তা নেই। এছাড়া সনদকে সংবিধানের ওপরে রাখা হয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির সৃষ্টি করতে পারে। ‘সনদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না’—এই অঙ্গীকারও সঠিক হয়নি।”
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি নিয়ে জামায়াতে ইসলামীও বিরোধিতা করছে। দলটি সংবিধানের ওপরে সনদের প্রাধান্য চেয়েছে এবং আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না এমন অঙ্গীকারের সমর্থন জানিয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মনে করছে, সনদের টেকসই বাস্তবায়নের জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়ন অপরিহার্য। এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “বর্তমান সংবিধানের ৬০–৭০ শতাংশ পরিবর্তন ছাড়া খসড়া সনদ কার্যকর করা সম্ভব নয়। এত বড় পরিবর্তন নতুন সংবিধান প্রণয়নের সমতুল্য। তবে নতুন সংবিধানের প্রবর্তনকে বাধা দেখানো হয়, যা পরিস্থিতিকে জটিল করছে।”
লিখিত মতামত ও নোট অব ডিসেন্ট
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তাবের ওপর ২৪টি রাজনৈতিক দল লিখিত মতামত জমা দিয়েছে। বেশির ভাগ দল আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সনদ কার্যকর করার দাবি জানিয়েছে।
তবে দলগুলো প্রধানত তিনটি ইস্যুতে ভিন্নমত প্রকাশ করেছে— আইনি স্পষ্টতা এবং বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, সময়সীমার অনুপস্থিতি এবং বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “চলতি সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় অমীমাংসিত বিষয়গুলোতে সমঝোতার চেষ্টা করা হবে। তবে এটি নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবাচক সহযোগিতার ওপর।”
রাজনৈতিক চাপ ও কৌশল
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিএনপির ওপর চাপ তৈরি করতে জামায়াত, ইসলামপন্থি দল এবং এনসিপি পাল্টা অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে পিআর পদ্ধতির দাবিতে আন্দোলনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সংবিধান ও সনদের উপর অবস্থান নিয়ে দলগুলোর মধ্যে পার্থক্য কমার কোনো লক্ষণ নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শফিকুল ইসলাম মন্তব্য করেছেন, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজের মূল চ্যালেঞ্জ হলো দলগুলোর অনড় অবস্থান। সংবিধান, আইনি ভিত্তি ও নির্বাচনের পূর্বসাপেক্ষ বাস্তবায়ন—এই তিনটি ইস্যুতে সমঝোতা ছাড়া সনদ কার্যকর করা কঠিন। সমাধান খুঁজতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে মূল ইস্যুতে নমনীয় হতে হবে।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদের প্রাথমিক খসড়া দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনার কাজ করবে। তবে দলগুলোর অনড় অবস্থান এবং আইনি স্পষ্টতার অভাব এই সনদের কার্যকর বাস্তবায়নকে চ্যালেঞ্জপূর্ণ করে তুলেছে। আগামী আলোচনা ও সংলাপগুলোই চূড়ান্ত সমাধানের পথ নির্ধারণ করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ