
ছবি: সংগৃহীত
দেশের সরকারি ব্যাংকগুলো এখন আর প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্কের কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায় নেই। দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল অবস্থায় থাকা এই ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম এখন বিদ্যমান সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে চলবে। পাশাপাশি প্রতিটি ব্যাংকের জন্য তিন বছরের দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে, যা বাস্তবায়নের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিশ্বব্যাংক আর্থিক সহায়তা প্রদান করবে।
পিসিএ ছাড়ের কারণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকারি ব্যাংকগুলো দূর্বল থাকায় পিসিএ কাঠামোর আওতায় তাদের সীমাবদ্ধতা আরোপ করলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পিসিএ নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর মূলধন, খেলাপি ঋণ, করপোরেট গভর্ন্যান্সসহ পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হয়। যেসব ব্যাংক সব সূচকে দুর্বল ধরা হবে, সেগুলোকে ক্যাটাগরি-৪ এ রাখা হবে এবং আমানত ও ঋণ বিতরণে বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।
কেন সরকারি ব্যাংকগুলোকে পিসিএর আওতায় আনা হলো না? কারণ, এই ব্যাংকগুলো সরকারি সেবা প্রদান, কৃষি, এসএমই এবং বড় ঋণ বিতরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া সরকারি প্রকল্প এবং প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থায়নও এ ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে হয়। পিসিএর কঠোর বিধিনিষেধ থাকলে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ ও আর্থিক কর্মকাণ্ডে বাধাপ্রাপ্ত হবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে।
এমওইউ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা
২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য এমওইউর মাধ্যমে তদারকি করছে। এই এমওইউর আওতায় ব্যাংকগুলোর অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতা নির্ধারণ করা হয় এবং ছয় মাস অন্তর প্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। তবে এত বছরেও ব্যাংকগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন উন্নতি করেনি। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়। এবার এমওইউর আওতায় তিন বছরের বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় প্রধানত অন্তর্ভুক্ত থাকবে—
মূলধন ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা
খেলাপি ঋণ কমানো ও ঋণ আদায় কার্যকর করা
ঋণ বিকেন্দ্রীকরণ
উচ্চ সুদের আমানত কমানো
পরিচালন দক্ষতা বৃদ্ধি
অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা
ডিজিটাল ব্যাংকিং সক্ষমতা বাড়ানো
এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মূলধন জোগানের জন্য সরকার একটি তহবিল গঠনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকও এই সংস্কারে ৪০০ মিলিয়ন ডলার প্রদান করতে সম্মত হয়েছে।
ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা
সর্বশেষ ২০২৪ সালের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দেখা গেছে, দেশের সরকারি ব্যাংকগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র এখনও উদ্বেগজনক।
জনতা ব্যাংক: খেলাপি ঋণ ৭২%, প্রভিশন ঘাটতি ২৭,৬৮০ কোটি টাকা, মূলধন ঘাটতি ৫২,৮৯০ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংক: খেলাপি ঋণ ১৮.৫%, প্রভিশন ঘাটতি ৯,৩০০ কোটি টাকা, মূলধন ঘাটতি মাত্র ৮২ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংক: খেলাপি ঋণ ৩৮.৫%, প্রভিশন ঘাটতি ৮,৮৮৯ কোটি টাকা, মূলধন ঘাটতি ৪,৬৮৬ কোটি টাকা।
রূপালী ব্যাংক: খেলাপি ঋণ ৩২%, প্রভিশন ঘাটতি ৭,০২১ কোটি টাকা, মূলধন ঘাটতি ৫,১৯২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক: খেলাপি ঋণ ৪৪%, প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি নেই।
বেসিক ব্যাংক: খেলাপি ঋণ ৮,৬০১ কোটি টাকা, প্রভিশন ঘাটতি ৫,১৭০ কোটি টাকা, মূলধন নেই।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক: খেলাপি ঋণ ৪,৯০২ কোটি টাকা (১৪.১১%), মূলধন ঘাটতি ১৮,১৮৮ কোটি টাকা।
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক: খেলাপি ঋণ ১,২৭৮ কোটি টাকা (১৭.২৬%), মূলধন ঘাটতি ২,৪৭০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করছেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কার্যকর করলে এই ব্যাংকগুলো সক্ষমতা বৃদ্ধি করে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং অর্থনীতিতে আরও অবদান রাখতে পারবে। তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, শুধুমাত্র এমওইউর আওতায় তদারকি করলে প্রত্যাশিত ফলাফল আনা কঠিন, তাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি আরও শক্তিশালী করতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, “পিসিএ নীতিমালা ছাড়াই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা সমাধানের ক্ষমতা রাখে। তবে সরকারি ও বেসরকারি সব ব্যাংককে সমানভাবে বিচার করা উচিত। সরকারি ব্যাংকগুলোকে দুর্বল বলা যায়, তবে তা দিনের মধ্যে নয়; এসব ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম ও খেলাপি ঋণের কারণে দুর্বল হয়ে গেছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “যেসব ব্যাংক চলতে পারছে না, তাদের বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”
সরকারি ব্যাংকগুলোকে পিসিএর আওতায় না নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে মূলধন ঘাটতি কমানো, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, পরিচালন দক্ষতা বৃদ্ধি, ঋণ বিতরণ সচল রাখা এবং ডিজিটাল ব্যাংকিং সম্প্রসারণে গুরুত্ব দেয়া হবে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক পুনরুদ্ধার ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিশ্বব্যাংক যৌথভাবে কাজ করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচও