
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন গভীর রাজনৈতিক সংকটে। দেশজুড়ে গণতন্ত্রের প্রত্যাশা ও পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে গঠিত এই সরকারের দশ মাস পূর্ণ হতে না হতেই পদত্যাগ ও বিভেদের গুঞ্জনে রাজনীতি অস্থির হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দল ও জোটের মাঝে অনৈক্য ও বিভাজন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একদিকে এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব বেড়েছে, অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গেও এনসিপির সম্পর্ক অবনতি ঘটেছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার আন্দোলনে ছাত্রশিবিরের ভূমিকা এবং জাতীয় সংগীত গাইতে বাধা দেওয়ার অভিযোগে এনসিপি ও সরকারের উপদেষ্টাদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে জামায়াতপন্থি সংগঠনগুলো।
এ পরিস্থিতিতে সরকারে থাকা উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে কেন্দ্র করে বিতর্ক আরও ঘনীভূত হয়। তার এক ফেসবুক পোস্ট ঘিরে ছাত্রশিবির তার পদত্যাগ দাবি করলে, তিনি পরে দুঃখ প্রকাশ করে লেখেন, "দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য অনিবার্য... বিভাজনমূলক শব্দচয়নগুলোর জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।" একইসঙ্গে, তিনি অভ্যুত্থানের সব শক্তির প্রতি সম্মান রেখে কাজ করার অঙ্গীকার জানান।
এদিকে এনসিপির নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি নিয়ে আবারও নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। আগারগাঁওয়ে বিক্ষোভ ও সমাবেশের মাধ্যমে দলটি জানিয়েছে, বর্তমান ইসির অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, "৫ আগস্টের পরে সবকিছু পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনের দিকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই ইসির ওপর আমাদের কোনো আস্থা নেই।"
অপরদিকে বিএনপি হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে রোডম্যাপ না দিলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করা হবে। বিতর্কিত উপদেষ্টাদের অপসারণ এবং উপদেষ্টা পরিষদ ছোট করার আহ্বানও জানিয়েছে দলটি। এছাড়া, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইস্যুতে ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানো নিয়ে জটিলতা, এবং ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার সাম্য হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন রাজনীতিকে আরও অস্থির করে তুলেছে।
গণঅধিকার পরিষদ পাঁচ দফা দাবিতে এক সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় সংলাপ শুরু ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। তাদের অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে—ছাত্র প্রতিনিধিদের পদত্যাগ, করিডোর-চট্টগ্রাম বন্দর ইস্যুতে সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকা এবং শেখ হাসিনার সময় নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসকদের প্রত্যাহার।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেখানে এখন সুপরিকল্পিতভাবে জাতীয় নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। বিভাজনের রাজনীতি আবারও শুরু হয়েছে।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে মূলধারার রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ঐকমত্যের অভাব, সরকারি উপদেষ্টাদের বিতর্কিত ভূমিকা এবং অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের ব্যর্থতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু—জাতীয় নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ, মিয়ানমার করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর ইস্যু—নিয়ে দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থানে অস্থিরতা তুঙ্গে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন বিষয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ভোট অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য সময়সীমা জানালেও, বিএনপি এই ‘বিভ্রান্তি’ মানতে নারাজ। তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন চায়। বিপরীতে এনসিপি নির্বাচনের আগে সংস্কারে অটল এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
সরকারের অভ্যন্তরেও বিভাজন বাড়ছে। বিশেষত, নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের তারেক রহমান সম্পর্কে মন্তব্যে বিএনপি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। রুহুল কবির রিজভী বলেন, “তারেক রহমানের লন্ডনে থাকা প্রসঙ্গে যেভাবে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, তা একদম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
বিভিন্ন দলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অনৈক্য, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, অকার্যকর সরকার ও নীতিনির্ধারকদের অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণের যে আশা ছিল তা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। এখন রাজনীতি একটি দিশাহীন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় সংলাপ ও নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা ছাড়া এই অস্থিরতা নিরসনের আর কোনো কার্যকর পথ নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ