
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের অব্যাহত সামরিক অভিযান এবং এর ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ মানবিক সংকট নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক ড. তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস। তিনি ইসরাইলকে আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা গাজাবাসীদের প্রতি 'দয়া' প্রদর্শন করে এবং নিজেদের স্বার্থেই একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজে বের করে। তাঁর মতে, এই যুদ্ধ ইসরাইলের জন্যও ক্ষতিকর এবং এর মাধ্যমে কখনোই দীর্ঘস্থায়ী শান্তি অর্জন সম্ভব নয়।
বৃহস্পতিবার (২২ মে) জেনেভায় ডব্লিউএইচওর বার্ষিক সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তেদরোস বলেন, “এই যুদ্ধ শুধু গাজার মানুষকেই নয়, ইসরাইলকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমি আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ জানাই—দয়া দেখান। এটি শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, ইসরাইলের নিজেদের স্বার্থেও প্রয়োজন। এটা মানবতার জন্যও জরুরি।”
তেদরোস, যিনি নিজেও ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে গাজার পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করতে পারছেন বলে জানান। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেন, “আমি জানি একজন মানুষ হিসেবে যুদ্ধ কী। গাজার শিশুদের কান্না আমি কল্পনা করতে পারি না, কারণ আমি সেটি শুনতে পাই। আমার ভেতরে যুদ্ধের শব্দ এখনো বেজে ওঠে। আমি পিটিএসডিতে ভুগছি। তাই আমি জানি গাজার মানুষ এখন কী ধরনের দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা সম্পূর্ণভাবে অমানবিক। চিকিৎসা সরঞ্জাম আটকে রেখে মানুষকে কষ্টে ফেলা আরও নিকৃষ্ট। এটি যুদ্ধের কোনও নৈতিকতা নয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে।”
ডব্লিউএইচও প্রধান জোর দিয়ে বলেন, “শুধু একটি রাজনৈতিক সমাধানই এই সংকট থেকে পথ বের করতে পারে। যদি সত্যিকারের শান্তি চান, তবে আগুন দিয়ে আগুন নেভানো যাবে না। যুদ্ধ দিয়ে শান্তি আসবে না।”
তেদরোসের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে ডব্লিউএইচওর জরুরি বিভাগের নির্বাহী পরিচালক ড. মাইকেল রায়ান বলেন, “গাজায় ২১ লাখ মানুষ সরাসরি মৃত্যুঝুঁকিতে আছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেখানে শুধু বোমার আঘাতেই নয়, অনাহার, ওষুধের অভাব এবং চিকিৎসা না পাওয়ায় মানুষ মারা যাচ্ছে। আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে—খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে, স্বাস্থ্যখাত পুনর্গঠন করতে হবে।”
তিনি আরও জানান, গাজার পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে সেখানে চিকিৎসাসেবা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। “গত সপ্তাহেই গাজার চারটি বড় হাসপাতালকে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এগুলোর অবস্থান এমন এলাকায় যেগুলো প্রতিনিয়ত গোলাবর্ষণের মধ্যে পড়ছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা আতঙ্কে থাকছেন, যন্ত্রপাতি ধ্বংস হয়ে গেছে, বিদ্যুৎ নেই, জেনারেটর চলানোর জ্বালানি নেই।”
জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থার এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ১৯টি হাসপাতাল আংশিক কার্যক্রম চালাতে পারছে। এর মধ্যেও ৯৪ শতাংশ হাসপাতাল কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। “যেসব হাসপাতাল চালু আছে, সেগুলোর কর্মীরা এক প্রকার অসম্ভব পরিবেশে কাজ করছেন। ওষুধ নেই, শয্যা নেই, অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি নেই। কিন্তু আহতের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে,”—বিবৃতিতে বলা হয়।
উত্তর গাজার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। সেখানে প্রায় সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়ে পড়েছে। অসংখ্য গর্ভবতী নারী, নবজাতক, ক্যান্সার রোগী, কিডনির ডায়ালাইসিস নেওয়া রোগীরা চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু বা মৃত্যুপথযাত্রী অবস্থায় আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ইসরাইল ও ফিলিস্তিন—উভয় পক্ষের জন্যই এখন সময় এসেছে মানবিকতা, সংবেদনশীলতা এবং দয়ার স্থান করে দেওয়ার। যুদ্ধের মাধ্যমে কেবল ধ্বংস ও মৃত্যু আসে, আর শান্তি আনে জীবন, উন্নয়ন ও নিরাপত্তা।
তেদরোসের এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাঁর বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তিকে দ্রুত হস্তক্ষেপ করে গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং পূর্ণাঙ্গ ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ