
ছবি: সংগৃহীত
সংস্থাটির ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের বিরুদ্ধে নিজেদের সাংবাদিকেরাই পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছেন। তাদের দাবি, সংস্থার সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা ইসরাইলপন্থী অবস্থান নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছে। এ কারণে গাজার ভয়াবহ মানবিক সংকট ও ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশা বিশ্ববাসীর কাছে যথাযথভাবে পৌঁছাচ্ছে না। এই তথ্য বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে সামনে আসে, যা শুক্রবার (২২ আগস্ট) আনাদোলু এজেন্সি প্রকাশ করে।
তীব্র সমালোচনার সূত্রপাত হয় চলতি আগস্ট মাসে। ইসরাইলি হামলায় নিহত হন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আনাস আল-শরিফ। তিনি এর আগে রয়টার্সে কাজ করেছেন এবং ২০২৪ সালে এই সংস্থার হয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। তার মৃত্যুর খবরে রয়টার্স যে শিরোনাম ব্যবহার করে, তা আরও বিতর্ক তৈরি করে। সংস্থাটি শিরোনাম দেয়— “ইসরাইল বলছে, হামাস নেতা ছিলেন এমন আল জাজিরা সাংবাদিককে হত্যা করেছে।”
এই সংবাদ শিরোনাম কেবল পাঠক-দর্শক মহলে ক্ষোভ তৈরি করেনি, বরং রয়টার্সের নিজস্ব সাংবাদিকদের ভেতরেও তীব্র অসন্তোষ ছড়িয়ে দেয়। তাদের মতে, এখানে একটি নিরপেক্ষ সাংবাদিককে কেবলমাত্র ইসরাইলি সেনাবাহিনীর বক্তব্যের ভিত্তিতে ‘হামাস নেতা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা মৌলিক সাংবাদিকতার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তদন্তমূলক সংস্থা ডিক্লাসিফায়েড ইউকে জানায়, রয়টার্সের বেশ কয়েকজন সাংবাদিক মিলে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। তারা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত ৪৯৯টি ইসরাইল-প্যালেস্টাইন ট্যাগযুক্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেন। এতে দেখা যায়, প্রতিবেদনগুলোতে ইসরাইলি স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পেয়েছে, অথচ ফিলিস্তিনি ভুক্তভোগীদের কণ্ঠ, অভিজ্ঞতা ও প্রেক্ষাপট তুলনামূলকভাবে অবহেলিত হয়েছে।
রয়টার্সের এক সাংবাদিক ওই তদন্ত সংস্থাকে বলেন, “৭ অক্টোবরের হামলার পর কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারি, আমাদের কাভারেজে নিরপেক্ষতা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।” এর পরিপ্রেক্ষিতে অভ্যন্তরীণভাবে একটি খোলা চিঠি প্রচার করা হয়, যেখানে গাজার কভারেজ আরও উন্নত করার আহ্বান জানানো হয়।
সাংবাদিকরা অভিযোগ তুলেছেন, রয়টার্সের নীতিমালায় ‘প্যালেস্টাইন’ শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাদের মতে, এটি সুস্পষ্ট পক্ষপাতের পরিচায়ক। একই সঙ্গে গাজায় ইসরাইলি হামলার কারণে মানবাধিকার সংস্থাগুলো যে ‘গণহত্যা’ শব্দ ব্যবহার করছে, তা সংবাদে সীমিতভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। অথচ ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো রয়টার্স যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে।
চাপের মুখে রয়টার্সের গ্লোবাল নিউজ ডেস্ক সম্পাদক হাওয়ার্ড এস. গলার ইমেইলের মাধ্যমে নতুন নির্দেশনা দেন। সেখানে বলা হয়, সাংবাদিকরা এখন ‘গণহত্যা’ শব্দ ব্যবহার করতে পারবেন, তবে অবশ্যই কোনো সূত্র বা বক্তব্যের ভিত্তিতে। তবে “প্যালেস্টাইন” শব্দের ব্যবহার এখনও সীমিত— কেবল ১৯৪৮ সালের আগের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে।
বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, নির্দেশনা শিথিল হওয়ার পরও জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রকাশিত ৩০০ প্রতিবেদনের মধ্যে মাত্র ১৪টিতে “গণহত্যা” শব্দটি এসেছে। এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঙ্গে সঙ্গে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের অস্বীকারোক্তি যুক্ত করা হয়েছে। সমালোচকদের মতে, এই ধরণের কাভারেজ কার্যত গণহত্যা অস্বীকারেরই আরেকটি ধরন।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক আসাল রাদ বলেন, “রয়টার্সের সংবাদে গাজায় ইসরাইলি হামলাকে সামরিক অভিযান বা যুদ্ধ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠানগুলো স্পষ্ট বলছে— এখানে গণহত্যা চলছে।”
ডিক্লাসিফায়েড ইউকের পর্যালোচনায় বলা হয়, রয়টার্সের আপডেটেড স্টাইলগাইডে ইসরাইলি দৃষ্টিভঙ্গি বারবার প্রাধান্য পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের ভূমিকাকে জোর দেওয়া হলেও ইসরাইলি দখলদারিত্ব, অ্যাপারথাইড নীতি, যুদ্ধবিরতি আলোচনার ব্যর্থতা বা দ্য ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত গাজার মৃত্যুহারের গবেষণা—এসব তথ্য কাভারেজে প্রায় উপেক্ষিত থাকে।
সমালোচনার মুখে রয়টার্স অবশ্য নিজেদের অবস্থান রক্ষা করেছে। সংস্থার একজন মুখপাত্র বলেন, “আমাদের কভারেজ ন্যায্য ও নিরপেক্ষ। এটি থমসন রয়টার্স ট্রাস্ট নীতির আলোকে পরিচালিত। আমাদের সাংবাদিকরা নিজেদের কাজ খুঁটিয়ে দেখেছেন এবং আমরা বিভিন্ন দিক থেকে মতামত সংগ্রহ করেছি।”
সব মিলিয়ে, ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে রয়টার্সের সংবাদ পরিবেশনের ধরন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি নিজের সাংবাদিকরাও প্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংবাদ কাভারেজে দ্বৈত মানদণ্ড কেবল ফিলিস্তিনি বাস্তবতাকে আড়ালই করছে না, বরং সাংবাদিকতার মূল মূল্যবোধকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ