
ছবি: সংগৃহীত
জাতিসংঘের সর্বশেষ প্রতিবেদনে গাজায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করা হলেও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার কার্যালয় এ দাবিকে সরাসরি অস্বীকার করেছে। জাতিসংঘের ঘোষণাকে নেতানিয়াহু ‘মিথ্যা’, ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ এবং ‘আধুনিক রক্ত অপবাদ’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ইসরাইল কখনো গাজায় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির নীতি গ্রহণ করেনি, বরং দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধেই কাজ করছে।
শনিবার (২৩ আগস্ট) এ নিয়ে এনডিটিভি একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
জাতিসংঘ-সমর্থিত ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ক্লাসিফিকেশন (IPC) এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়, বর্তমানে গাজায় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে। যদি চলমান পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তবে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৬ লাখ ৪০ হাজার মানুষ ‘বিপর্যয়কর খাদ্য-নিরাপত্তাহীনতা’ (ফেজ-৫) অবস্থায় পৌঁছাবে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ক্ষুধা ও অপুষ্টিজনিত কারণে এখন পর্যন্ত ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ১১৪ জন শিশু।
জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনের তীব্র সমালোচনা করে নেতানিয়াহু তার এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে লেখেন, “ইসরাইলের কোনো নীতি দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির জন্য নয়। আমাদের সব প্রচেষ্টা হলো দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করা। প্রকৃতপক্ষে, একমাত্র যাদের ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে রাখা হচ্ছে, তারা হলো ইসরাইলি জিম্মিরা। গাজায় দুর্ভিক্ষ হচ্ছে—এই দাবি একটি আধুনিক রক্ত অপবাদ, যা পক্ষপাতের আগুনে ছড়িয়ে পড়ছে।”
‘রক্ত অপবাদ’ শব্দটির ঐতিহাসিক তাৎপর্যও নেতানিয়াহুর বার্তায় উঠে আসে। মধ্যযুগ থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত ইউরোপে ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্রচলিত ছিল এই অভিযোগ—খ্রিস্টান শিশুদের হত্যা করে তাদের রক্ত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। নেতানিয়াহু ইঙ্গিত দেন, জাতিসংঘের বর্তমান বক্তব্যও একই ধরনের মিথ্যা প্রচারণার অংশ।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় পর্যাপ্ত খাদ্যসাহায্য পৌঁছাচ্ছে না। তবে নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, জুলাই মাসেই জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ১,০১২টি সাহায্যবাহী ট্রাক সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর মধ্যে মাত্র ১০টি ট্রাক নির্ধারিত গুদামে পৌঁছেছে, আর বাকিগুলো পথে বিতরণের আগেই লুট হয়ে গেছে।
তিনি স্বীকার করেন, কিছু সময়ের জন্য সাহায্যের ঘাটতি হয়েছিল। তবে সেটি মোকাবিলা করা হয়েছে— আকাশপথে সরবরাহ, সমুদ্রপথে সাহায্য পাঠানো, নিরাপদ পরিবহন রুট চালু করা, এবং আমেরিকান কোম্পানির মাধ্যমে বিতরণ কেন্দ্র পরিচালনার মাধ্যমে।
যদিও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিতে সাহায্য সরবরাহ ব্যবস্থার নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে, তবে তিনি গাজার ওপর ইসরাইলের আরোপিত অবরোধের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন। মার্চ মাসে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি বিনিময় চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার পর থেকেই এই অবরোধ জোরদার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করছে, অবরোধের কারণে গাজায় খাদ্য, পানি ও ওষুধ সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
জাতিসংঘের দুর্ভিক্ষ ঘোষণাকে ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে একদিকে উদ্বেগ ও নিন্দার ঝড় উঠলেও, ইসরাইল সরকারের পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হচ্ছে—তাদের উদ্দেশ্য মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়া, কোনোভাবেই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি নয়। তবে বাস্তবে গাজার ক্ষুধার্ত শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চাপ আরও বেড়ে চলেছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, জাতিসংঘের সতর্কবার্তা ও ইসরাইলের অস্বীকৃতি—দুটি ভিন্ন অবস্থান এখন তীব্র রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। গাজার লাখ লাখ মানুষের জীবন ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই সংকট কিভাবে সমাধান হয় তার ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ