
ছবি: সংগৃহীত
দেশে জাতীয় নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনি প্রস্তুতি তৎপরভাবে শুরু করেছে, তবে এবারের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে সেনাবাহিনী শুধু স্ট্রাইকিং ফোর্স নয়, বরং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো পূর্ণ ক্ষমতায় দায়িত্ব পালন করবে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ) সংশোধন করে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে প্রস্তাব পাঠাতে যাচ্ছে। নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ও পুলিশের ক্ষমতা প্রদান করা হবে, যাতে তারা স্বাধীনভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ জানিয়েছেন, ‘আমরা আরপিও সংশোধন করে সেখানে ল’এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি হিসাবে সেনাবাহিনীকেও অন্তর্ভুক্ত করেছি। আগে শুধু পুলিশ, কোস্টগার্ড ও বিজিবি ছিল। এখন সেনাবাহিনীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হলো। প্রস্তাবটি এ সপ্তাহের মধ্যেই সরকারের কাছে পাঠানো হবে।’
১৬ বছর আগে আরপিওর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকা থেকে সেনাবাহিনী বাদ দেওয়া হয়েছিল। তবে নির্বাচন কমিশন ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবারের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও অন্যান্য নির্বাচনে সেনাবাহিনী পূর্ণ ক্ষমতায় দায়িত্ব পালন করলে ভোটারদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে।
২০০১ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রথমবার আরপিও সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ৮৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, নির্বাচনি দায়িত্ব পালনকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য পুলিশ কর্মকর্তা না হলেও নির্বাচনি অপরাধের জন্য কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবে। তবে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার ওই সংশোধনী থেকে প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগ বাদ দেয়।
নির্বাচন কমিশন এবার যে সংশোধনী প্রস্তাব পাঠিয়েছে, তাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সব নির্বাচনেই সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির ভিত্তিতে এই প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এটি বাস্তব রূপ পাবে।
এবারের নির্বাচনে প্রায় দেড় লাখ পুলিশ মোতায়েন থাকবে। এছাড়া বিজিবি, কোস্টগার্ড ও আনসারও দায়িত্ব পালন করবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, নির্বাচনে প্রায় ৮০ হাজারের বেশি সেনা সদস্য মোতায়েন করা হবে।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘আরপিও সংশোধনী হলে নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পাওয়া সেনা সদস্যরা ম্যাজিস্ট্রেসি এবং পুলিশের ক্ষমতা একসঙ্গে পাবেন। আগে তারা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান করতেন। কোনো সমস্যা হলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন নিতে হতো। কিন্তু এখন স্বাধীনভাবে ডেপ্লয়মেন্ট ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু সেনাবাহিনী এই প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে। পূর্ণ ক্ষমতায় দায়িত্ব পালন করলে নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এটি অনেক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ মনে করেন, ‘বাংলাদেশের বাস্তবতায় নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া অপরিহার্য। শুধু স্ট্রাইকিং ফোর্স নয়, পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এবং আইনশৃঙ্খলায় বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে না।’
নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক আইনজীবী অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম বলেন, ‘আগে সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। তখন তারা চাইলেও স্বাধীনভাবে ব্যবস্থা নিতে পারত না। ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন দরকার হতো। আরপিও সংশোধন হলে তারা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। বড় বা একাধিক এলাকায় নির্বাচন হলে এটি ইতিবাচক হবে।’ তবে তিনি উল্লেখ করেন, সুষ্ঠু নির্বাচন সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের মনোভাবের ওপর নির্ভর করবে।
ইসি মাছউদ বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। আমরা মনে করেছি, শুধু জাতীয় নির্বাচনে নয়, সব নির্বাচনেই সেনাবাহিনী থাকা উচিত। তাই এটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হয়েছে। এখন কমিশন সেনা সদর দপ্তরের সঙ্গে আলাপ করে প্রয়োজনীয় ফোর্স চাইতে পারবে এবং তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সব দায়িত্ব পালন করতে পারবে। এটি এখন আইনের অধীনে।’
সেনাবাহিনীকে নির্বাচনে পূর্ণ ক্ষমতায় দায়িত্ব প্রদান ও আরপিও সংশোধন নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ভোটার আস্থা বৃদ্ধির পাশাপাশি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করবে, যা নির্বাচনের নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচও