
ছবি: সংগৃহীত
গত ১৮ মাসে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে দেড় লাখ রোহিঙ্গা। সীমান্তবর্তী এলাকায় আরও প্রায় ৫০ হাজার মানুষ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করছে, তারা সম্ভাব্যভাবে মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে কক্সবাজারে সরকারের উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী স্টেকহোল্ডারস ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের জন্য মাসিক খাদ্য বরাদ্দ মাথাপিছু ১২ মার্কিন ডলার এবং নোয়াখালীর ভাসানচর আশ্রয়শিবিরে ১৩ ডলার করেছে। বরাদ্দ ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বহাল থাকবে, ১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন বরাদ্দ নির্ধারণ করা হবে। তবে খাদ্যসহায়তা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, “জাতিসংঘ খাদ্য তহবিলের অর্থ সীমিত, আগামী নভেম্বরে ক্যাম্পে খাবারের জোগান নিশ্চিত করতে তহবিলের ব্যবস্থা এখনও হয়নি। এছাড়াও এলপিজি সিলিন্ডার সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলও নেই, যা গাছ কাটা বাড়িয়ে দিতে পারে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, “খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা অপর্যাপ্ত থাকলে, শরণার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, আশেপাশের দেশগুলোও প্রভাবিত করবে।” — মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ড. রাশিদা খান।
রাখাইন রাজ্যের অবনতি এবং নতুন সংঘর্ষের কারণে সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় হাজারো রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান জানিয়েছেন, সীমান্তে ৬২ জন রোহিঙ্গাকে প্রতিহত করা হয়েছে। নাফ নদী এবং স্থলসীমান্তে বিজিবি সতর্ক অবস্থানে আছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “গত ১৮ মাসে দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেখভালের তহবিল বন্ধ করেছে, যা বড় সমস্যা তৈরি করছে। এই সংকট শুধু বাংলাদেশ নয়, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া সহ বিভিন্ন আসিয়ান দেশকেও প্রভাবিত করছে।”
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ চলছে। গত চার বছরের মধ্যে আটটি সশস্ত্র গ্রুপ—আরসা, আরএসও, এআরএ, নবি হোসেন গ্রুপ, মাস্টার মুন্না গ্রুপ, দীল মোহাম্মদ ওরফে মার্স গ্রুপ, ডাকাত সালমান গ্রুপ ও ডাকাত সাদ্দাম গ্রুপ—এর মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ২০২ জন নিহত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “ক্যাম্পগুলো এখন অপরাধ ও সন্ত্রাসের আখড়া হিসেবে পরিণত হয়েছে। এখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রভাবিত হচ্ছে।” — মন্তব্য করেছেন সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ কাদের আজিজ।
২৪ থেকে ২৬ আগস্ট কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত স্টেকহোল্ডারস ডায়ালগ হচ্ছে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনের প্রস্তুতিমূলক সংলাপ। এতে অংশগ্রহণ করছেন দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ, কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা।
সংলাপের দ্বিতীয় দিনে প্রধান অতিথি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত থাকবেন। অংশগ্রহণকারীরা সরাসরি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন। সংলাপ থেকে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো আগামী সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে প্রস্তাবনা হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।
ডায়ালগ বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখছে, রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও যুবকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরা, যাতে স্থায়ী সমাধান ও মানবিক সহায়তা কার্যকর হয়।
রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে জীবনযাত্রা সংকুচিত, অপরাধ প্রবণতা বেড়ে চলেছে এবং সীমান্তে নতুনদের প্রবেশের চাপ বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবিদ ড. তানভীর হোসেন বলেন, “যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত ও যথাযথ সহায়তা না দেয়, তাহলে মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হবে এবং এটি শুধু শরণার্থী নয়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনকেও প্রভাবিত করবে।”
পরিস্থিতি যেভাবে চলছে, তাতে খাদ্য, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুনর্বাসন—এসব ক্ষেত্রের সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা ছাড়া রোহিঙ্গা সংকট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
সম্প্রতি সীমান্তে অবস্থানরত প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা এবং ক্যাম্পে থাকা ১৩ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ২০১৭ সালের আগের পরের কয়েক মাসে প্রবেশ করেছে। যেভাবে রাখাইনে সংঘাত চলতে থাকে, তাতে নতুন রোহিঙ্গাদের প্রবেশ অব্যাহত থাকতে পারে, যা সংকটকে আরও জটিল করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ