
ছবি: সংগৃহীত
গত জুলাই মাসে সারা দেশে সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানির হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এক মাসে সড়ক দুর্ঘটনাই প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ৫২০ জনের, আহত হয়েছে এক হাজার ৩৫৬ জন। শুধু সড়ক নয়, রেলপথ ও নৌপথেও দুর্ঘটনা ঘটেছে উল্লেখযোগ্য হারে, যা মিলিয়ে মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৫৪ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৫৬৮ জন। আহত হয়েছেন অন্তত ১ হাজার ৪১১ জন।
সড়ক দুর্ঘটনায় শীর্ষে ঢাকা বিভাগ, সর্বনিম্ন বরিশাল
মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) দুপুরে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই তথ্য তুলে ধরেন। সংগঠনের দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা করে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে।
তথ্য অনুযায়ী, সদ্যবিদায়ী জুলাই মাসে সারাদেশে ৫০৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫২০ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৫৬ জন আহত হন। সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ঢাকা বিভাগে, যেখানে ১২২টি দুর্ঘটনায় ১৩০ জনের প্রাণহানি ও ২৯৫ জন আহত হয়েছেন। অপরদিকে বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনার সংখ্যা সবচেয়ে কম—২৩টি দুর্ঘটনায় নিহত ২৩ জন ও আহত ৯৫ জন।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এক-তৃতীয়াংশ মৃত্যু
প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুলাই মাসে মোট ১৬২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৯ জন নিহত ও ১৪৪ জন আহত হয়েছেন। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩২.০১ শতাংশ, মোট নিহতের ৩২.৫০ শতাংশ এবং আহতের ১০.৬১ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ভয়াবহতা স্পষ্ট করে তুলছে।
রেল ও নৌ দুর্ঘটনার চিত্র
শুধু সড়ক নয়, জুলাই মাসে রেলপথেও নেমে আসে দুর্ঘটনার ছায়া। এ সময় রেলপথে ৩৪টি দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত ও ৪১ জন আহত হন। নৌপথে ঘটে ১৪টি দুর্ঘটনা, যাতে ১৭ জন নিহত, ১৪ জন আহত এবং ৫ জন নিখোঁজ রয়েছে। তিন মাধ্যম মিলিয়ে মোট ৫৫৪টি দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ৫৬৮ জনের, আর আহত হন ১ হাজার ৪১১ জন।
দুর্ঘটনার পেছনে একাধিক কারণ
যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে একাধিক কাঠামোগত ও মানবিক কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে—
বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সড়কে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি।
সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, সিএনজি, নসিমন-করিমনের অবাধ চলাচল।
জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিং ও সড়কবাতির অভাব, ফলে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা।
মিডিয়ান বা ডিভাইডারের অভাব এবং গাছপালা ও অবকাঠামোর কারণে অন্ধবাঁক তৈরি।
মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি ও ট্রাফিক আইন অমান্যের প্রবণতা।
উল্টোপথে যান চলাচল, সড়কে চাঁদাবাজি, পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী পরিবহন।
অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রী বহন।
বেপরোয়া ড্রাইভিং এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম ছাড়া দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানো।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ১৪ দফা সুপারিশ
দুর্ঘটনা রোধে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে—
বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-মহাসড়ক জরুরি ভিত্তিতে মেরামত।
জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতের আলোকসজ্জা নিশ্চিত করা।
দক্ষ চালক তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ জোরদার এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদান।
গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়কে ফুটপাত ও সার্ভিস লেইন নির্মাণ।
সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ, চালকের ন্যায্য বেতন ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিত।
মহাসড়কে নিরাপদ পথচারী পারাপারের ব্যবস্থা, রোড সাইন ও রোড মার্কিং স্থাপন।
সড়ক পরিবহন আইনকে উন্নত বিশ্বের মতো ডিজিটাল প্রযুক্তিতে প্রয়োগ।
সারাদেশে আধুনিক বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি।
মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা।
নিয়মিত রোড সেফটি অডিট চালু রাখা।
মেয়াদোত্তীর্ণ ও দীর্ঘদিন ফিটনেসবিহীন যানবাহন স্ক্র্যাপ করা।
ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নেওয়া চালকদের ওপর থেকে ভ্যাট ও আয়কর অব্যাহতি।
মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশার আমদানি ও নিবন্ধন নিয়ন্ত্রণ।
উদ্বেগের কারণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি মাসে এভাবে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়তে থাকলে সড়ক নিরাপত্তা আরও হুমকির মুখে পড়বে। মোটরসাইকেলের প্রসার, অদক্ষ চালক এবং সড়কের ভঙ্গুর অবস্থা দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হলেও, কার্যকর পদক্ষেপের অভাব পরিস্থিতি আরও জটিল করছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, চালক, পরিবহন মালিক এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। না হলে, সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনার মিছিল থামানো যাবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ