
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোর নানা ধাক্কা ও সংকট কাটিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তার ভাষায়, “অর্থনীতি খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসে এখন একটি স্বস্তির জায়গায় দাঁড়িয়েছে।”
মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) দুপুরে সচিবালয়ে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ বক্তব্য দেন। এ সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, “আমরা গত এক বছরের মধ্যে একের পর এক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি—অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, রিজার্ভ সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, এমনকি বৈদেশিক বিনিয়োগের ধীরগতি। তবুও ধাপে ধাপে নেওয়া নীতিমালা ও সংস্কারের ফলে অর্থনীতি এখন ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার দিকে ফিরছে।”
তার মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে দেশের অর্থনীতি ছিল চরম চাপের মুখে, যেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশের মতো। কিন্তু বর্তমান আর্থিক বছরের শেষে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
অর্থ উপদেষ্টা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকেও আলোকপাত করেন। তিনি জানান, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ শতাংশ, যা তখন ছিল এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। ধাপে ধাপে নীতি হস্তক্ষেপ, খাদ্য আমদানি সহজীকরণ, বাজার মনিটরিং ও জ্বালানি খাতের কিছু স্থিতিশীলতার কারণে তা ২০২৪ সালের জুলাই মাসে নেমে এসেছে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশে।
তিনি বলেন, “এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। তবে এখানেই থেমে গেলে হবে না। লক্ষ্য থাকবে মুদ্রাস্ফীতি আরও কমিয়ে ৬ শতাংশের আশেপাশে নিয়ে আসা, যাতে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ হ্রাস পায়।”
ড. সালেহউদ্দিন জানান, সরকারের পক্ষ থেকে এখন যে সংস্কার কার্যক্রম চলছে—বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, খেলাপি ঋণ কমানো, কর ব্যবস্থা স্বচ্ছ করা, এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা—তা অব্যাহত থাকবে। তার ভাষায়, “আমরা ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত আর্থিক খাতের সংস্কার চালিয়ে যাবো। অর্থনীতির প্রতিটি খাতে দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই এখন মূল লক্ষ্য।”
অর্থ উপদেষ্টা মনে করেন, দেশের অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উন্নতি বড় ভূমিকা রেখেছে। বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন কিছুটা স্বাভাবিক হওয়া, জ্বালানির দামের ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতা, এবং প্রবাসী আয়ে ইতিবাচক প্রবণতা—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন পুনরুদ্ধারের পথে।
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, “প্রবাসী আয়ে জুলাই মাসে রেকর্ড ২.২ বিলিয়ন ডলার এসেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৮ শতাংশ বেশি। রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রেও ধীরে ধীরে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে।”
তবে আশাবাদের পাশাপাশি ড. সালেহউদ্দিন কিছু সতর্কবার্তাও দেন। তিনি বলেন, “যদিও অর্থনীতি স্বস্তির জায়গায় এসেছে, কিন্তু এখনও আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ আছে—রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ছাড়া এসব লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে।”
তার মতে, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক উন্নতি টেকসই করতে হলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পায়নে মনোযোগ দিতে হবে।
সবশেষে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আমরা খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসেছি, কিন্তু এখনো নিরাপদ পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাইনি। স্বস্তি এসেছে, কিন্তু আত্মতুষ্টি নয়—এই মনোভাব নিয়েই আমাদের এগোতে হবে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ