
ছবি: সংগৃহীত
গত এক বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও শাসন ব্যবস্থায় কিছু অগ্রগতি থাকলেও কাঠামোগত ও শাসনগত সমস্যাগুলো এখনও অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় কিছু পুনরুজ্জীবনের ছাপ থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়নের জন্য গভীর সংস্কার ছাড়া এগুলো ধরে রাখা কঠিন। জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা আসায় সিপিডি ইতিবাচক সাড়া জানিয়েছে, তবে আগামী দিনে জাতীয় অর্থনীতি ও শাসন ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে দৃঢ় পদক্ষেপের গুরুত্ব জোর দিয়ে বলেছেন তারা।
গতকাল (১০ আগস্ট) রাজধানীর হোটেল লেকশোরে অনুষ্ঠিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন দেশের গত এক বছরের অর্থনৈতিক, শাসন ও জনসেবার অবস্থা বিস্তারিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে শ্রম ও নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, সাবেক উপদেষ্টা ম. তামিম, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু, বিটিএমইএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ এস এম আমানুল্লাহ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন এবং গণমাধ্যম সংস্কার কমিটির সদস্য জিমি আমিরসহ অনেক বিশিষ্টজন অংশ নেন।
ড. ফাহমিদা খাতুন জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সামান্য বেড়েছে যা কঠোর পাচার বিরোধী ব্যবস্থা, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং সরকারি ব্যয়ের শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যবস্থাপনার ফলাফল। তবে এ সাফল্যগুলো গভীর ও টেকসই সংস্কারের অভাবে অস্থায়ী হতে পারে।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি এখনও উদ্বেগজনক উচ্চমাত্রায় রয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ও সরবরাহ শৃঙ্খলে জটিলতা এই মুদ্রাস্ফীতির মূল কারণ। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি খুব ধীর গতিতে চলছে, বিশেষত তৈরি পোশাক খাতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বেড়েছে এবং অর্থনীতির বৈচিত্র্যকরণ যথাযথ গতি পাচ্ছে না। সামষ্টিক অর্থনীতি ও শাসন ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কারে এখনও তেমন অগ্রগতি নেই।
ড. খাতুন বলেন, নীতির ধারাবাহিকতা প্রয়োজন, কিন্তু শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোনো সংস্কার টেকসই হবে না। তিনি স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠন, সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং সেবার স্থানীয়করণ জোরদারের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
সিপিডির সামাজিক ক্ষেত্রের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিস্তার থাকলেও কর্মক্ষমতা ও অপচয় এখনো বিদ্যমান। স্বাস্থ্য খাত সংকটাপন্ন এবং বাজেট বরাদ্দের পদ্ধতিগত দুর্বলতার কারণে সঠিক সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। শিক্ষার মান অপরিবর্তিত থেকে যাওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি মানবসম্পদ উন্নয়নে উদ্বেগ রয়েছে। নগর ও গ্রামীণ অঞ্চলের মধ্যে অবকাঠামো বিনিয়োগে বৈষম্য বেড়েছে, যা সামাজিক অস্থিরতা ও অভিবাসন চাপ বাড়াচ্ছে।
সিপিডি অন্তর্বর্তী প্রশাসনের মধ্যেও নাগরিক অংশগ্রহণ ও সংসদীয় নজরদারি জোরদারের পরামর্শ দিয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, যা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে না।
উপরন্তু, সংস্থাটি অন্তর্বর্তী সরকারের বাকি সময়ের জন্য কিছু অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপের সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে: খাদ্য বাজারে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে লক্ষ্যভিত্তিক উদ্যোগ, রপ্তানিতে বৈচিত্র্যকরণ দ্রুততর করা বিশেষত আইটি, ফার্মাসিউটিক্যালস ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সেবা মান উন্নয়ন, স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠন ও তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি এবং অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন তহবিল সমানভাবে বরাদ্দ নিশ্চিত করা।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিগত ১৫ বছর ধরে ভেঙে পড়া কাঠামোর পুনর্গঠন একটি চ্যালেঞ্জ হলেও শুরু করা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, পরিবর্তনের মাধ্যমে এখন আর কাউকে গুম করা হয় না, তবে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। শ্রম খাতে নানা জটিলতা রয়েছে, যা রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সমাধান কঠিন।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু উল্লেখ করেন, ব্যাংক লাইসেন্স প্রদানে দুর্নীতি বন্ধ করা জরুরি এবং ব্যাংক মার্জোগুলোতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, নীতিগত সহায়তা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগের আগমন কঠিন হবে। এছাড়া সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৩০ শতাংশের মতো পরিমাণ ভুয়া বলে উল্লেখ করেন।
বিটিএমইএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল মন্তব্য করেন, ৩৬৫ দিনে কোনো ম্যাজিকেল উন্নতি দেখা যায়নি এবং দেশের টেক্সটাইল শিল্পের বৃদ্ধির হার শূন্য বা নেগেটিভ।
অর্থনীতিবিদ ম. তামিম বলেন, গ্যাস স্বল্পতা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বড় ধরনের ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সিপিডির আলোচনায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা অন্তর্বর্তী সরকারের গত এক বছরে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট ও প্রশাসনিক দুর্বলতার প্রতি তাদের উদ্বেগ ব্যক্ত করেন। শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের কাছে রাতের বেলা নিরাপদে বাসায় ফেরা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে রিকশা শ্রমিক নেতাও অভিযোগ করেন।
সিপিডির মতে, অন্তর্বর্তী সরকার একটি তুলনামূলক স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, তবে এখন সময় এসেছে স্বল্পমেয়াদি সংকট মোকাবিলা থেকে বেরিয়ে দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই ও কাঠামোগত সংস্কারে মনোনিবেশ করার। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার কিভাবে একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারবে, সেটিই ভবিষ্যৎ সাফল্যের মাপকাঠি হবে।
সূত্র: সিপিডি
বাংলাবার্তা/এমএইচ