ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নজিরবিহীন নজরদারির কেন্দ্রে এখন দুই ভাই—শাহ মোহাম্মদ মারুফ ও শাহ আরিফ। অভিযোগ, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে দু’জনই সরকারি চাকরি নিয়েছেন, আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গড়েছেন অস্বাভাবিক ও বহুগুণ সম্পদ। শুধু চাকরির বেতন নয়—নামে-বেনামে জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি—সব মিলিয়ে তাদের সম্পদের পরিমাণ কোটি টাকায়। যে সম্পদের সঙ্গে বৈধ আয় বা জীবনধারার কোনো সম্পর্ক নেই।
দুদক ইতোমধ্যে এনবিআরের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে শাহ মোহাম্মদ মারুফের চাকরিতে যোগদানের সময় জমা দেওয়া সব কাগজপত্র—বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ—চাকরির পিডিএস, যোগদানের কপি, বেতন-ভাতার তালিকা, বিভিন্ন দপ্তরে পদায়নের নথি, এবং চাকরিজীবনে সংগৃহীত অন্যান্য রেকর্ড দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি তার ভাই শাহ আরিফের সরকারি চাকরির নথিও চাওয়া হয়েছে। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সহকারী পরিচালক মো. সোহরাব হোসেন সোহেল।
দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ওঠে সরকারি চাকরির মূল ভিত্তি—মুক্তিযোদ্ধা কোটার সনদ—ভুয়া হওয়ার বিষয়ে। এনবিআর সূত্র জানায়, শাহ মোহাম্মদ মারুফ ২০১০ সালে ২৮তম বিসিএসের মাধ্যমে সহকারী কর কমিশনার হিসেবে যোগদান করেন। তখন চাকরিতে সুবিধা পেতে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটার সনদ জমা দেন। একই সনদের সূত্রেই তার ভাই শাহ আরিফও চাকরি পান।
এখন প্রশ্ন উঠে এসেছে—সেই সনদ আদৌ বৈধ কিনা? নাকি জালিয়াতির মাধ্যমে একটি অদৃশ্য নেটওয়ার্কের সহায়তায় দুই ভাই চাকরির সুযোগ নিয়েছেন?
এনবিআর সূত্রে পাওয়া সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য—মাত্র প্রায় ৮০ হাজার টাকা মাসিক বেতন পাওয়া শাহ মোহাম্মদ মারুফ রাজধানীর সবচেয়ে অভিজাত এলাকা বারিধারা কূটনৈতিক জোনে ১২ কোটি টাকায় কিনেছেন একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট।
ফ্ল্যাটের বিবরণ:
-
ভবনের নাম: বিটিআই উইন্ড ফ্লাওয়ার
-
অবস্থান: বারিধারা কূটনৈতিক এলাকা, সড়ক নম্বর ১১
-
পুরো ভবনে ১০টি ইউনিট, প্রতিটি একটি করে তলা
-
মারুফের ফ্ল্যাট: সপ্তম তলা
-
আয়তন: ৩,২০০ বর্গফুট
-
প্রতি বর্গফুট মূল্য: অন্তত ৪০,০০০ টাকা
-
ইন্টেরিয়র: বিদেশি বাথরুম ফিটিংস, দামি আসবাব, কয়েক কোটি টাকার সাজসজ্জা
ফ্ল্যাটটি কেনা হয়েছে স্ত্রীর নামে—তবে এখনো নিবন্ধন হয়নি। কারণ, স্ত্রীর আয়কর ফাইল বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নথিতে দেখা যায়, স্ত্রী সাদিয়া আফরিন একসময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান “ইউনিয়ন ডেভেলপমেন্ট”-এ চাকরি করতেন। বর্তমানে তিনি গৃহিণী, আর আয়কর ফাইলে তার সম্পদের পরিমাণ মাত্র ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অথচ ১২ কোটি টাকার ফ্ল্যাট কেনার তথ্য তার বৈধ আয়ের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
কর গোয়েন্দা ইউনিটের তদন্তে এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে:
-
মারুফ ও তার পরিবারের নামে সম্পদ: প্রায় ৩০ কোটি টাকা
-
আয়কর নথিতে দেখানো সম্পদ: ৪ কোটি ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা
-
সরকারি চাকরি জীবনের মোট বৈধ আয়: মাত্র ৮০ লাখ টাকা
-
বারিধারার ফ্ল্যাট: ১২ কোটি+
-
স্ত্রী-স্বামীর নামে গাড়ি: ২টি (স্ত্রীর গাড়ির দাম ৮০ লাখ টাকা)
এছাড়া আরও পাওয়া গেছে:
জমি:
-
পূর্বাচলের রূপগঞ্জ অংশের গোলাপ মৌজায়—১৫ কাঠা জমি (তিন ভাইয়ের নামে)
-
উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টর—৩ কাঠা প্লট (মারুফের নামে)
-
নিকুঞ্জ ৫ নম্বর রোড—৩ কাঠা প্লট (বোনের নামে)
-
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য
তদন্তে প্রমাণিত হলে এসব সম্পদের বিপরীতে সর্বোচ্চ কর নির্ধারণ করা হবে, পাশাপাশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালে গোপালগঞ্জ সদর এবং কাশিয়ানী এলাকা থেকে আসার কারণে মারুফ প্রশাসনে বিশেষ প্রভাব ব্যবহার করেছেন। তিনি কর অঞ্চল–৪, ৫, ১২ এবং নারায়ণগঞ্জ সার্কেলের মতো অত্যন্ত ‘লাভজনক’ জায়গায় পোস্টিং নিয়েছেন।
কর্মকর্তাদের অভিযোগ:
-
বড় করদাতাদের কর ফাঁকি দিতে সহযোগিতা করে তিনি মোটা অঙ্কের ঘুষ নিতেন
-
অবৈধ অর্থকে বৈধ দেখাতে বছরে বছরে সম্পদ কিনেছেন
-
কখনও নিজের নামে, কখনও স্ত্রী, ভাই বা বোনের নামে সম্পদ রেজিস্ট্রি করেছেন
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন,
“কর অঞ্চল–৫-এ তার সময়েই সর্বাধিক অভিযোগ এসেছে। অনেক করদাতা পরোক্ষভাবে জানিয়েছিলেন, টাকা না দিলে তাদের ফাইল আটকে রাখা হতো।”
দুদকের চিঠি পাওয়ার পর এনবিআর ইতোমধ্যে মারুফকে বরখাস্ত করেছে। একই সঙ্গে কর গোয়েন্দা বিভাগ তার এবং তার স্ত্রীর সব ব্যাংক হিসাব, সম্পত্তির কাগজপত্র, গাড়ির মালিকানা, অস্বাভাবিক লেনদেন এবং বিভিন্ন সময়ে ঘোষিত সম্পদের বিবরণ সংগ্রহ করছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে:
-
মুক্তিযোদ্ধা সনদের সত্যতা যাচাই
-
চাকরির জন্য জমা দেওয়া সব সনদের সত্যায়িত কপি
-
বিভিন্ন কর সার্কেলে তার ভূমিকা, অভিযোগ, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
-
ভাইয়ের চাকরির নথি
-
সম্পদ বৃদ্ধির টাইমলাইন
সব দপ্তর থেকে তথ্য পাওয়ার পর দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরি করবে দুদক।
এনবিআর ও দুদক উভয় প্রতিষ্ঠান এখন “নামে-বেনামে সম্পদ”—এই একটি বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। তাই মারুফের—
-
সম্পদের উৎস
-
ফ্ল্যাট কেনার লেনদেন
-
স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব
-
সরকারি চাকরিতে দুর্নীতি
-
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ
এসব প্রশ্ন থেকে তিনি কোনোভাবেই রেহাই পাবেন না।
একজন দুদক কর্মকর্তার ভাষায়— “মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতি আর সরকারি চাকরিতে দুর্নীতি—এ দুটি অভিযোগই গুরুতর। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। ফলে তদন্ত শেষ হলে চার্জশিট নিশ্চিত।”
রাষ্ট্র, রাজস্ব এবং জনগণের সঙ্গে বহুস্তরীয় প্রতারণার অভিযোগে শাহ মোহাম্মদ মারুফ ও তার ভাই শাহ আরিফ এখন বড় ধরনের আইনি ঝুঁকিতে। ভুয়া সনদের মাধ্যমে সরকারি চাকরি, ঘুষের টাকায় সম্পদের পাহাড় গড়া এবং ক্ষমতার অপব্যবহার—সব মিলিয়ে এটি সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত রাজস্ব-দুর্নীতির মামলা হয়ে উঠছে।
দুদক ও এনবিআরের নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে, এবং তদন্ত অগ্রসর হওয়ায় শিগগিরই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক মামলা হতে পারে—এমন ধারণা দপ্তরসংশ্লিষ্টদের।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



