ছবি: সংগৃহীত
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থেকেও সরকারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া অভিযোগে বাতিল হতে যাচ্ছে অন্তত ১২৭ জন ‘জুলাই যোদ্ধা’র গেজেট। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং এই তালিকা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। খুব শিগগিরই তাঁদের গেজেট বাতিল করে আনুষ্ঠানিক প্রজ্ঞাপন জারি করা হতে পারে। এটি হবে জুলাই আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরকারি গেজেট বাতিলের ঘটনা।
সম্প্রতি নেত্রকোনার একটি উপজেলা থেকে তিন তরুণ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে হাজির হন। তাঁরা অভিযোগ করেন, গত কয়েক মাস ধরে তাঁরা জুলাই যোদ্ধা হিসেবে ঘোষিত ভাতা পাচ্ছেন না। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা তাঁদের গেজেট নম্বর যাচাই করে জানান, জেলা কমিটি তাঁদের তিনজনের নাম বাতিলের সুপারিশ করেছে। ফলে সাময়িকভাবে তাঁদের ভাতা বন্ধ রাখা হয়েছে। এই ঘটনাই ইঙ্গিত দেয়, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে জুলাই যোদ্ধাদের তালিকা ঘিরে।
জুলাই যোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশের পর থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে অসংগতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে। অভিযোগ ওঠে—অনেকেই আন্দোলনে আহত হননি, কেউ সরাসরি অংশই নেননি, আবার কেউ চিকিৎসা সনদ ছাড়াই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এ ধরনের অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জেলা কমিটিগুলোর মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে।
যাচাই শেষে দেখা যায়, বাতিলের সুপারিশকৃত ১২৭ জনের মধ্যে অন্তত ১০৪ জনই আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাঁরা হয় আন্দোলনের সময় আহত হননি, নয়তো কোনোভাবেই অংশগ্রহণের প্রমাণ দেখাতে পারেননি। আরও বিস্ময়কর হলো, ২৩ জনের নাম একাধিকবার এসেছে একই তালিকায়—যার মধ্যে কেউ কেউ দুই বা তিনবার করে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সর্বাধিক গেজেট বাতিলের সুপারিশ এসেছে চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে—মোট ৩৯ জন। এর মধ্যে ৩৫ জনই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এ ছাড়া সিলেট বিভাগ থেকে ২৭ জন, ময়মনসিংহ থেকে ২১ জন, ঢাকা বিভাগ থেকে ১৪ জন, রাজশাহী থেকে ১৩ জন, খুলনা থেকে ৯ জন এবং বরিশাল ও রংপুর থেকে সর্বনিম্ন সংখ্যা এসেছে। বরিশালের দুজন এবং চট্টগ্রামের চারজনের নাম একাধিকবার এসেছে একই তালিকায়।
বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, বাতিলের জন্য সুপারিশকৃতদের অধিকাংশই ‘গ’ শ্রেণির (আহত) জুলাই যোদ্ধা। তুলনামূলকভাবে ‘ক’ (অতি গুরুতর আহত) ও ‘খ’ (গুরুতর আহত) শ্রেণির ক্ষেত্রে সংখ্যা খুবই কম।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, “আগের তালিকাগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ এসেছে যে তালিকাভুক্তদের কেউ কেউ প্রকৃতপক্ষে আহত ছিলেন না বা আন্দোলনে অংশই নেননি। এসব নিয়ে সরকার গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।”
এর আগে গত ৩ আগস্ট শহীদদের তালিকা থেকেও আটজনের নাম বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল মন্ত্রণালয়। বর্তমানে সরকারি হিসাব অনুযায়ী শহীদের সংখ্যা ৮৩৬ জন। তবে এবারই প্রথমবারের মতো জুলাই যোদ্ধা হিসেবে ঘোষিত কারও গেজেট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তরের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন, “আমরা প্রতিটি জেলার প্রশাসককে নির্দেশনা দিয়েছি, যেন তাঁরা গেজেটভুক্ত জুলাই যোদ্ধা ও শহীদদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাঠান। স্থানীয় কমিটি, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং প্রাপ্ত অভিযোগ—সবকিছু মিলিয়ে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মিলেছে, তাঁদের গেজেটই বাতিলের প্রক্রিয়ায় আছে।”
এই অনুসন্ধান কার্যক্রমে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন, জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ অনেকেই যুক্ত রয়েছেন। জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
গত ১৭ জুন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে। এরপর ২০ আগস্ট ওই অধ্যাদেশের ভিত্তিতে বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। সেখানে প্রতিটি জেলায় একটি করে কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক করা হয়, যা নতুন আবেদন যাচাই ও পুরোনো গেজেট পুনর্মূল্যায়নের দায়িত্বে রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, জেলা কমিটিগুলো থেকেই প্রথম দফায় ১২৭ জনের নাম বাতিলের সুপারিশ আসে। পরবর্তীতে জুলাই ফাউন্ডেশনের অভিযোগ ও মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব যাচাই-বাছাই মিলিয়ে এই সংখ্যা চূড়ান্ত করা হয়।
মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. মামুনুর রহমান মাঠপর্যায়ের যাচাইয়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, “আমরা দেখেছি, অনেকের চিকিৎসার সঠিক কাগজ নেই। কেউ কেউ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও অন্য কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। আবার কেউ শুধুমাত্র শুনেছেন, কিন্তু সরাসরি অংশ নেননি। এসব কারণেই অনেক নাম নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলেছি।”
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি শুধু প্রথম ধাপ। যাচাই-বাছাই চলমান রয়েছে এবং আরও নাম বাতিল হতে পারে। একই সঙ্গে প্রকৃত আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সম্মান ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে নতুন করে ডাটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে।
সরকারি তালিকায় বর্তমানে ‘অতি গুরুতর আহত’ (ক), ‘গুরুতর আহত’ (খ) ও ‘আহত’ (গ)—এই তিন শ্রেণিতে মোট জুলাই যোদ্ধার সংখ্যা ১৩ হাজার ৮০০ জন। তবে মন্ত্রণালয় সূত্র মনে করছে, এই সংখ্যা পর্যালোচনার পর আরও কমে যেতে পারে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। তবে আন্দোলনের গৌরবময় ঐতিহ্যের সঙ্গে যেন কেউ ভুয়া পরিচয়ে যুক্ত না হতে পারে, সে লক্ষ্যে সরকার এবার কঠোর অবস্থানে। আসন্ন প্রজ্ঞাপন সেই অবস্থানেরই প্রতিফলন হতে যাচ্ছে—যেখানে ১২৭ জনের গেজেট বাতিল হবে, আর আরও অনেকের নাম পুনর্বিবেচনায় থাকবে।
এতে যেমন ভুয়া দাবি ও অপব্যবহারের অবসান ঘটবে, তেমনি প্রকৃত জুলাই যোদ্ধাদের মর্যাদাও নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



