ছবি: সংগৃহীত
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে দৃঢ় অঙ্গীকার পাওয়া গেছে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে। নির্বাচন করবেন যিনি—প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা কমিশনটি হোক, তবে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় মূল ভূমিকায় রয়েছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। এখানেই প্রশ্ন ওঠে: বর্তমান প্রশাসন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে কতটা প্রস্তুত আছে?
ঐতিহ্যগতভাবে Election Commission of Bangladesh (ইসি) নির্বাচন আয়োজনের মূল দায়িত্ব পালন করে থাকলেও, ভোটদানের দিন সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করার মূল দায়িত্বে রয়েছে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। ডিসি রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে জেলার নির্বাচন প্রক্রিয়া তদারকি করেন, আর ইউএনও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে ভূমিকা রাখেন।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ১৫ মাসে প্রশাসনের কাঠামো অনেকাংশে ঠিকমতো কাজ করতে পারেনি—অগোছালো অবস্থায় রয়েছে অনেক বিভাগ। শীর্ষ পর্যায়ে যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের মধ্যে যোগ্যতার স্বাক্ষর স্পষ্টভাবে দেখা যায়নি। ফলে বর্তমান প্রশাসন সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীন প্রশ্নের মুখোমুখি।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, “যদি আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকে, তাহলে এখনও প্রশাসনের সুযোগ রয়েছে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভালো একটি নির্বাচন উপহার দেয়ার”। এই জন্য যা প্রয়োজন— যোগ্য ও সাহসী কর্মকর্তাদের ডিসি–ইউএনও পদে নিয়োগ দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল বাড়ানো ও তাদের নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া।
সাবেক সচিব এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, “নির্বাচনের দায়িত্ব গ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে বলি—ভোট কেমন হবে তা নির্ভর করছে আপনি ডিসি ও ইউএনও হিসেবে কাদের নিয়োগ দিচ্ছেন তার ওপর। তাদের কমিটমেন্ট, নিরপেক্ষতা, ঈমানের জোর দেখতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সময়কার নির্বাচনের মতো এমন একটা ক্রেডিবল প্রশাসন ও পরিচালনা পরিগঠন আজ নেই। মানুষের কাছে এখন এমন বিশ্বাস নেই যে প্রশাসন কোন বড় ভূমিকা নিয়েই নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে।”
প্রখ্যাত জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া-এর মতে, “প্রশাসনের মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে—যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভয় পায় ‘ভুল করলে হবে শাস্তি’ এমন মনোবল নিয়ে এগোয়, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।” তিনি সতর্ক করেন, ভেতরের ভয় কোথাও যদি না দূর হয়, তাহলে প্রশাসনের কাজে সবচেয়ে বড় বাঁধা মনোবলহীনতা।
বর্তমান সময়ে প্রশাসনের সামনে কয়েকটি প্রধান চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
-
শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পদে গত এক বছরের মধ্যে বড় ধরনের বদলি ও নিয়োগ হয়েছে। অনেক কর্মকর্তা এখনো চাকরি থেকে অবসরে গিয়েছেন বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে রয়েছেন, ফলে শৃঙ্খলা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে।
-
улсরাজনৈতিক দলগুলোর আস্থায় প্রশাসন নেই—অনেক রাজনৈতিক নেতা প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলছেন। এই সন্দেহই নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ওপর বড় ছায়া ফেলে।
-
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী (পুলিশ ইত্যাদি)–র মনোবল সংকটে রয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সময়ে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা ভয় বা অনিশ্চয়তার মুখে রয়েছে।
-
সময় সংকট রয়েছে—ভোট আয়োজনের প্রস্তুতির জন্য মাত্র কয়েক মাস সময় হাতে। টফসিল ঘোষণার পর প্রশাসন ইসির অধীনে যাবে, তাই এখন থেকেই সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
যেকিছু সমস্যা থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনা পুরোপুরি শেষ হয়েছে, তা নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনি যদি সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়—যেমন যোগ্য ডিসি-ইউএনও নিয়োগ, প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেতৃত্ব ও মনোবল উন্নয়ন, রাজনৈতিক দল-অভিযোগ মোকাবিলা—তাহলে ভালো নির্বাচন সম্ভব।
মো. আউয়াল মজুমদার বলেন: “আপনি যদি যেকোনো সময় ঘুরে দাঁড়ান—বিভ্রাট ও ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি এগিয়ে যান—তাহলে এখনো দৌড়ে ধরার সুযোগ রয়েছে।”
তিনি যোগ করেন, “মাঠ-প্রশাসনে উপস্থিত একজন যোগ্য ডিসি রাজনীতিবিদসহ সবাইকে কৌশলে নিয়ন্ত্রণে এনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবেন।”
সরকার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রশাসনের দায়িত্বপূর্ণ পদায়নে প্রধান উপদেষ্টা নিজেই তদারকির দায়িত্ব দেবেন। একদিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব এই কাজের তদারকিতে রয়েছেন, অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা সোজাসুজি বলছেন—যিনি শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্ষম, তাকে নির্বাচনকালীন দায়িত্ব দেওয়া হবে। প্রশাসনের পদায়ন ও বদলিতে রাজনৈতিক দল-মতভেদ কমিয়ে দক্ষতা ও নিরপেক্ষতাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব দায়িত্বগ্রহণের সময় বলেছেন, “নির্বাচনকালীন কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তা দেওয়া আমার দায়িত্ব। আমি এই দায়িত্ব নিজে নিয়েছি।”
সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য শুধু নির্বাচন কমিশনের ভালো কাজরর প্রয়োজন নয়—প্রশাসনের সক্ষমতা, মনোবল ও নিরপেক্ষতা সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। বর্তমান সময়ে প্রশাসনের সামর্থ্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় রয়েছে; তবুও এখনি যদি সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সময় এখনও রয়েছে।
সময়ে-সাপেক্ষ পদক্ষেপের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব—যদি প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ করে যায়। তবে যদি প্রস্তুতি না হয়, নিম্নমানের নির্বাচন হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশেষজ্ঞ-মণ্ডলী।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



