ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি হবে ২০০৮ সালের পর প্রথমবারের মতো ইইউর বৃহৎ পরিসরের পর্যবেক্ষক দল প্রেরণ, যা বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এ তথ্য জানান। প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে রাষ্ট্রদূত মিলার বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে একটি বৃহৎ পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তিনি জানান, “এই মিশনের অনুমোদন প্রক্রিয়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে আমরা আশা করছি, এতে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ জন সদস্য থাকবেন। এর মধ্যে অগ্রবর্তী পর্যবেক্ষক দল ভোটের ছয় সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে পৌঁছাবে, বাকিরা ভোটের এক সপ্তাহ আগে যোগ দেবেন।”
রাষ্ট্রদূত মিলার আরও বলেন, ২০০৮ সালের পর এটিই হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এই দল নির্বাচনের আগে থেকে ভোট গ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণার পরবর্তী পর্যায় পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।
এছাড়া স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোকেও সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের। তিনি বলেন, “আমরা চাই স্থানীয় পর্যবেক্ষকদেরও সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করতে, যাতে তারা মাঠপর্যায়ের তথ্য ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে পারেন।”
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলারের মধ্যে সাংবিধানিক সংস্কার, নির্বাচন প্রস্তুতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, শ্রম খাতের সংস্কার, মানবাধিকার সুরক্ষা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্প্রসারণসহ বিস্তৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা জানান, “নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ রাখার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা চাই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই প্রক্রিয়ার অংশ হোক, যাতে সব পক্ষই নির্বাচনের ফলাফলে আস্থা রাখতে পারে।”
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রসারে আলোচনা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত মিলার বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে দেখে। উভয়পক্ষই অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (EPA) নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের রপ্তানি সম্ভাবনা বিশাল, বিশেষ করে তৈরি পোশাক, ওষুধ, জাহাজ নির্মাণ ও কৃষিপণ্য খাতে ইইউ নতুন বিনিয়োগ সুযোগ বিবেচনা করছে।”
এ সময় বিমান ও নৌপরিবহন খাতে নতুন সহযোগিতা সম্ভাবনা নিয়েও কথা হয়। রাষ্ট্রদূত মিলার উল্লেখ করেন, ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে আগ্রহ বাড়ছে।
প্রধান উপদেষ্টা জানান, “চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া টার্মিনালকে আধুনিক রূপ দিতে ডেনমার্কভিত্তিক বৈশ্বিক শিপিং কোম্পানি এ.পি. মোলার-মায়ার্সকের সঙ্গে একটি চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগে টার্মিনালটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উন্নত সুবিধাসম্পন্ন স্থানে পরিণত হবে।”
এছাড়া মানব পাচার, অবৈধ অভিবাসন ও শ্রম অধিকার সুরক্ষা নিয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বজায় রাখার বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হন। রাষ্ট্রদূত মিলার বলেন, “বাংলাদেশ ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী দেশ। আমরা চাই, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী হোক, যাতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়।”
বৈঠকের শেষে রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার আশাবাদ ব্যক্ত করেন, “আসন্ন নির্বাচন হবে বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনকে সহায়ক, শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।”
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ ইইউ পর্যবেক্ষণ মিশন পাঠানো হয়েছিল ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনগুলোতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেবল সীমিত পর্যবেক্ষক বা কারিগরি মূল্যায়ন মিশন পাঠিয়েছিল। এবার দীর্ঘ বিরতির পর একটি বড় ও সংগঠিত মিশনের প্রস্তুতি বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে কূটনৈতিক মহল মনে করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



