ছবি: সংগৃহীত
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাব এখন নতুন এক সাংবিধানিক পর্যায়ে প্রবেশ করছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সর্বশেষ সুপারিশ অনুযায়ী, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদই দ্বৈত দায়িত্ব পালন করবে—একই সঙ্গে এটি হবে সংসদ এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ। ২৭০ দিন বা নয় মাসের মধ্যে এ পরিষদকে জুলাই জাতীয় সনদে উল্লেখিত সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের সুযোগ দেওয়া হবে। সময়সীমার মধ্যে বাস্তবায়ন সম্পন্ন না হলে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে।
এই প্রস্তাবের অংশ হিসেবে গণভোট আয়োজনের কথাও নিশ্চিত করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে সরকার ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ জারি করবে। এই আদেশের আলোকে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচনের দিন বা তার আগেও। তবে গণভোটে রাজনৈতিক দলগুলোর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ থাকবে না।
ড. আলী রীয়াজ জানান, গণভোটে জনগণের সামনে একটি মূল প্রশ্ন উপস্থাপন করা হবে—জুলাই জাতীয় সনদে উল্লিখিত ৪৮টি সাংবিধানিক বিষয় বাস্তবায়নের ব্যাপারে জনগণের সম্মতি আছে কি না। এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরই নির্ভর করবে পরবর্তী প্রক্রিয়া। যদি গণভোটে জনগণের সম্মতি মেলে, তাহলে ভোটের সংখ্যানুপাতে ১০০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। কিন্তু যদি জনগণ নেতিবাচক রায় দেয়, তবে সংস্কার প্রক্রিয়া থেমে যাবে।
তিনি বলেন, ‘গণভোটের বিষয়টি নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই এই প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য। তবে এটি আয়োজনের তারিখ ও কারিগরি দিকগুলো সরকার ও নির্বাচন কমিশন যৌথভাবে নির্ধারণ করবে।’
সংসদই হবে সংস্কার পরিষদ, পৃথক শপথে শুরু হবে কার্যক্রম
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, আগামী সংসদই একযোগে জাতীয় সংসদ এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। সংসদের সদস্যরা সংসদ সদস্য হিসেবে ও সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে পৃথক শপথ নেবেন। পরিষদের নিজস্ব কার্যবিধি থাকবে এবং জাতীয় সংসদের স্পিকারই এর সভাপতি হবেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে ডেপুটি স্পিকার দায়িত্ব পালন করবেন। প্রয়োজনে পরিষদের গঠিত সভাপতি প্যানেল থেকে কাউকে সভার সভাপতিত্বের দায়িত্ব দেওয়া যাবে।
২৭০ দিনের জন্য কার্যকর এই সংস্কার পরিষদ জুলাই সনদে উল্লেখিত ৪৮টি সাংবিধানিক প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন বা বিয়োজনের কাজ করবে। এই সময়ের মধ্যে সংসদ তার স্বাভাবিক আইন প্রণয়ন কার্যক্রমও চালিয়ে যাবে। ৯ মাস শেষে পরিষদ বিলুপ্ত হবে এবং সংস্কার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সংবিধানের অংশ হয়ে যাবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সংক্রান্ত বিষয়গুলো গণভোটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। বরং এসব মতভেদ জনগণের রায়ের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আমরা সরকারকে বলেছি—এই ভিন্নমতের বিষয়গুলো জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হোক। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে কোন প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য, কোনটি নয়।’
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন তিন ধাপে সম্পন্ন হবে।
প্রথম ধাপে, সাংবিধানিক নয় এমন প্রস্তাবগুলো সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারবে।
দ্বিতীয় ধাপে, যেসব প্রস্তাব অফিস আদেশ বা প্রশাসনিক নির্দেশনার মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়েছে।
তৃতীয় ধাপে, সাংবিধানিক সংশোধনের বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যেখানে জনগণের সম্মতিতে সেগুলো সংবিধানে যুক্ত হবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “গণভোটের জন্য একটি মাত্র প্রশ্ন থাকবে, কিন্তু সেই প্রশ্নের মধ্যে সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত ৪৮টি প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত থাকবে। জনগণের সম্মতিই হবে এই সংস্কারের বৈধতার মূল উৎস।”
ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি গণভোটে জনগণের সম্মতি পাওয়া যায়, তাহলে জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠার ৪৫ দিনের মধ্যে ১০০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষ গঠনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উচ্চকক্ষের গঠন হবে জনগণের ভোটের সংখ্যানুপাতে, যা দেশের সংসদীয় কাঠামোয় প্রথমবারের মতো ‘দ্বিকক্ষবিশিষ্ট’ (bicameral) ব্যবস্থার সূচনা ঘটাবে।
এখনও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি। এ প্রসঙ্গে ড. আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা যোগাযোগ রাখছি। আশা করি বাকি তিন দিনের মধ্যে তারাও স্বাক্ষর করবে। কারণ, এটি শুধু সরকারের নয়, পুরো জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের একটি প্রক্রিয়া।”
উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকার সুশাসন, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিরোধের লক্ষ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল। এসব কমিশন সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমনব্যবস্থা সংস্কারে নির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়। এরপর এসব সুপারিশের ঐকমত্য গঠনের জন্য গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যারা ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা শেষে জুলাই জাতীয় সনদ প্রস্তুত করে।
৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে প্রণীত এই সনদে ইতিমধ্যে ২৫টি দল ও জোট স্বাক্ষর করেছে। তারা সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকারও দিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা মনে করি, এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এক নতুন ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবে। জনগণই হবে এখানকার চূড়ান্ত রেফারি। আমরা শুধু একটি কাঠামো প্রস্তাব করেছি—এখন সিদ্ধান্ত হবে জনগণের ভোটে, জনগণের রায়ে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “গণভোট শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি জনগণের মালিকানার প্রতীক। আমরা আশা করি, সরকার দ্রুত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসে গণভোটের তারিখ ও প্রক্রিয়া নির্ধারণ করবে, যেন আগামী জাতীয় নির্বাচন ও সাংবিধানিক সংস্কার একসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক রূপ নেয়।”
এইভাবে, জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এখন নতুন পর্যায়ে—যেখানে নির্বাচন, গণভোট এবং সাংবিধানিক সংস্কার মিলেমিশে এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



