ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বর্তমানে এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নে কিছু অগ্রগতি অর্জন করলেও রাজস্ব ঘাটতি, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধিকে ক্রমাগত চাপের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও দৃঢ় নীতি গ্রহণ এবং সংস্কার বাস্তবায়ন জরুরি—এমনটাই স্পষ্ট করে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
আইএমএফের এ সতর্কতামূলক বার্তা এসেছে সংস্থাটির ১৬ দিনের ঢাকা সফর শেষে। ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে আইএমএফের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল গত ২৯ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, নীতিনির্ধারক, বেসরকারি খাত ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করে। সফর শেষে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে বিস্তারিত মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়।
দুর্বল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বড় ঝুঁকি
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্নের একটি। পর্যাপ্ত রাজস্ব সংগ্রহ না হওয়ায় সরকারের ব্যয় বাড়ছে, কিন্তু আয়ের পথ বাড়ছে না। এর ফলে সরকারি ঋণের চাপ বাড়ছে, বাজেট ঘাটতি বেড়ে চলেছে এবং উন্নয়ন ব্যয় সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
আইএমএফের মন্তব্য—যদি রাজস্ব সংগ্রহ দ্রুত বৃদ্ধি না পায়, তবে আর্থিক খাতের দুর্বলতা মোকাবিলায় সরকার প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহে হিমশিম খাবে। ফলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে।
সংস্থাটি সুপারিশ করেছে—
-
কর আইন সরল ও আধুনিক করা,
-
কর অব্যাহতির অযৌক্তিক সুবিধা সীমিত করা,
-
কর প্রশাসনে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি,
-
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ানো,
-
ভ্যাট-আয়কর উভয় খাতে ফাঁকফোকর বন্ধ করা।
আইএমএফের মতে, এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের রাজস্ব আয় আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে এবং অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরবে।
ব্যাংকিং খাত: সংকটে মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণ
আইএমএফের বিবৃতিতে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে ‘অবশ্যম্ভাবী সংস্কারের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংস্থাটির মতে—
-
বহু ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি রয়েছে,
-
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিন ধরেই লোকসান করছে,
-
বেসরকারি খাতেও খেলাপি ঋণের হার স্থিতিশীল নয়,
-
ব্যাংক পরিচালনায় পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে।
সংস্থাটি স্পষ্ট করে জানায়, দুর্বল ব্যাংকগুলো আলাদা করে সনাক্ত করতে হবে এবং একটি সুসংহত পুনর্গঠনের রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। সেখানে থাকবে—
-
মূলধন ঘাটতির পরিমাণ শনাক্তকরণ,
-
কীভাবে সেই ঘাটতি পূরণ করা হবে তার পরিকল্পনা,
-
সরকারি বিনিয়োগ বা সহায়তার প্রয়োজনীয়তা,
-
ব্যাংক পরিচালনায় নতুন নিয়ম ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো,
-
খেলাপি ঋণ উদ্ধার প্রক্রিয়া দ্রুততর করার ব্যবস্থা।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান পুনর্মূল্যায়নও জরুরি বলে আইএমএফ মত দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আরও বাড়াতে হবে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও কঠোর মুদ্রানীতি অব্যাহত রাখার সুপারিশ
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক থেকে কিছুটা কমে ৮ শতাংশে এসেছে। তবে এটি এখনও ৫–৬ শতাংশের কাঙ্ক্ষিত সীমার ওপরে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর মুদ্রানীতি অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্পষ্ট পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
এর মধ্যে রয়েছে—
-
সুদের হার বাজারভিত্তিক রাখা,
-
টাকার দর বাজার-নির্ধারিত রাখতে স্থিতিস্থাপক বিনিময় হার বজায় রাখা,
-
ঋণ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা,
-
মুদ্রানীতিতে রাজনৈতিক চাপমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
আইএমএফ জানিয়েছে, কঠোর মুদ্রানীতি চালিয়ে যেতে পারলে ২০২৫–২৬ এবং ২০২৬–২৭ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫ শতাংশে ফিরে আসতে পারে।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কাঠামোগত সংস্কার জরুরি
আইএমএফের মতে, বাংলাদেশের মধ্যমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য তিনটি ক্ষেত্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—
-
শাসনব্যবস্থা ও সুশাসন শক্তিশালীকরণ
-
যুব বেকারত্ব কমানো
-
অর্থনীতির বৈচিত্র্য বৃদ্ধি
যুব বেকারত্ব বর্তমানে দেশের অন্যতম তীব্র সমস্যা। উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈচিত্র্যের অভাব একদিকে বৈদেশিক আয়কে সীমিত করছে, অন্যদিকে প্রযুক্তিগত রূপান্তরে অগ্রগতি কমছে। এসব মোকাবিলায় কাঠামোগত সংস্কারের বিকল্প নেই।
আইএমএফ ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি স্থগিত—নির্বাচনের পর সিদ্ধান্ত
বাংলাদেশ আইএমএফের বেইলআউট কর্মসূচির আওতায় মোট ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকটি কিস্তি পাওয়া গেছে। তবে ষষ্ঠ কিস্তি (৮০ কোটি ডলার) ছাড়ের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছে। কারণ ডিসেম্বরের নির্ধারিত বিতরণসূচি এখন দেশের ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের পর নেওয়া হবে।
আইএমএফ জানিয়েছে, নির্বাচন-পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সংস্কার বাস্তবায়নের গতি বিবেচনায় নিয়ে কিস্তি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হবে। এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে অবহিত করা হয়েছে।
আইএমএফের সতর্কবার্তা: এখনই সংস্কার নয়তো বড় ঝুঁকি
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইএমএফের সাম্প্রতিক বিবৃতি বাংলাদেশের জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ সতর্কসংকেত’। সংস্থাটি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে—
-
রাজস্ব আয় না বাড়লে,
-
ব্যাংক খাতে কাঠামোগত সংস্কার না হলে,
-
মুদ্রানীতি কঠোর না থাকলে—
বাংলাদেশের সামষ্টিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে। প্রবৃদ্ধি কমবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে, বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যাবে এবং আর্থিক ঝুঁকি আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, খেলাপি ঋণ কমানো, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, প্রশাসনিক দুর্বলতা সংশোধন এবং আর্থিক বিধিবিধান কঠোরভাবে প্রয়োগ করা এখন সময়ের দাবি।
আইএমএফের সামগ্রিক পরামর্শ—সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন, রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি ও আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করলেই অর্থনীতি টেকসই স্থিতিশীলতার পথে ফিরে আসবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



