ছবি: সংগৃহীত
রাজশাহী বিভাগের ৩৯টি আসনের মধ্যে ৩৪টিতে বিএনপি যে প্রার্থী ঘোষণা করেছে, তা কেন্দ্রীয়ভাবে দলীয় সিদ্ধান্ত হলেও মাঠপর্যায়ে এর প্রতিক্রিয়া হচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে উত্তপ্ত ও বিভক্তিমূলক। মনোনয়নপ্রাপ্তদের নাম চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, জয়পুরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জজুড়ে শুরু হয়েছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, সংবাদ সম্মেলন, পালটাপালটি সমাবেশ—সব মিলিয়ে পুরো এলাকায় দলীয় দ্বন্দ্ব এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
বহু আসনে মনোনয়ন বঞ্চিত প্রভাবশালী নেতাদের অনুসারীরা খোলাখুলিভাবে মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়েছেন। কোথাও কোথাও পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুপস্থিতি বা নিষ্ক্রিয়তা দলের ভেতর সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। মনোনীত প্রার্থীদের অভিযোগ—এই বিক্ষোভগুলো পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলক, যা দলীয় ঐক্য ভাঙতে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের প্রার্থীদের সুবিধা করে দিতে পারে।
রাজশাহীর বিভিন্ন আসনে উত্তেজনা: সড়ক অবরোধে স্থবির যোগাযোগ ব্যবস্থা
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে মনোনয়ন পাওয়া শফিকুল হক মিলনকে প্রত্যাহারের দাবিতে মনোনয়নবঞ্চিত রায়হানুল হক ও নাসির হোসেনের অনুসারীরা রাজশাহী–ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করেন। টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভের কারণে প্রায় এক ঘণ্টা যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। স্থানীয় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নামলেও নেতাকর্মীরা সড়ক ছাড়তে অনীহা দেখান।
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া–দুর্গাপুর) আসনে নজরুল ইসলাম মণ্ডলকে প্রার্থী ঘোষণা করতেই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে বঞ্চিত প্রার্থীদের মধ্যে। বাকি চার মনোনয়নপ্রত্যাশীর অনুসারীরা প্রথমে সংবাদ সম্মেলন, পরে শিবপুরে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে দুই পাশে শত শত যান আটকে পড়ে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে মশাল মিছিল, স্থলবন্দর সড়ক অবরোধ
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনে ৯০ বছর বয়সি অধ্যাপক শাজাহান মিয়ার মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি অংশ। তারা বলছেন, দীর্ঘ সময় বিদেশে থাকায় তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় নন, দলে নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াননি, এমনকি প্রচারেও অংশ নিতে পারবেন না। মনোনয়নপ্রত্যাশী সৈয়দ শাহীন শওকতের সমর্থকরা মশাল মিছিল নিয়ে কয়লাবাড়ী এলাকায় সোনামসজিদ স্থলবন্দর সড়ক অবরোধ করেন। এর আগেও কানসাট এলাকায় সড়ক অবরোধ করা হয়। শওকত নিজেও ফেসবুকে মনোনয়ন বঞ্চনার অভিযোগ তুলে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন, যা আরও তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল–গোমস্তাপুর–ভোলাহাট) আসনে আমিনুল ইসলামের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে নাচোল ডাকবাংলা প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করেন ইঞ্জিনিয়ার ইমদাদুল হক মাসুদের অনুসারীরা। তারা আমিনুলকে সরাসরি ‘ফ্যাসিস্ট শাসনের সহযোগী’ বলে অভিযুক্ত করেন।
নওগাঁয় ৩ আসনে বিক্ষোভ, অবরোধ ও পাল্টা সমাবেশ
নওগাঁ-১ (সাপাহার–পোরশা–নিয়ামতপুর) আসনে মোস্তাফিজুর রহমানের প্রার্থিতা বাতিলের দাবিতে মনোনয়নবঞ্চিত সাবেক সংসদ সদস্য ছালেক চৌধুরীর অনুসারীরা সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন। ছালেক তিনবারের এমপি হওয়ায় তার বঞ্চনা স্থানীয়ভাবে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর–বদলগাছি) আসনে মনোনয়ন পাওয়া ফজলে হুদা বাবলুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন পারভেজ আরেফিন সিদ্দিকী জনির অনুসারীরা। জনি সাবেক ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকীর ছেলে হওয়ায় তার বঞ্চনা নেতাকর্মীদের মধ্যেও তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।
নওগাঁ-৪ (মান্দা) আসনে ইকরামুল বারী টিপুর মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদল সভাপতি আব্দুল মতিনের সমর্থকরা রাজশাহী–নওগাঁ মহাসড়ক অবরোধ করেন। কয়েকদিন ধরেই তারা নানা কর্মসূচি পালন করছেন।
নাটোর ও পাবনায় একাধিক আসনে একই দৃশ্য
নাটোর-১ (লালপুর–বাগাতিপাড়া) আসনে সাবেক মন্ত্রী ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে ব্যারিস্টার ফারজানা শারমিন পুতুলকে মনোনয়ন দেওয়ায় ক্ষুব্ধ মনোনয়নবঞ্চিত ডা. ইয়াসির আরশাদের অনুসারীরা লালপুর–বনপাড়া সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। স্থানীয় নেতাদের ভাষ্য—এমন বিভক্ত পরিস্থিতি চলতে থাকলে বিএনপি এ আসনে টিকে থাকতে পারবে না।
পাবনা-৩ (চাটমোহর–ভাঙ্গুড়া–ফরিদপুর) আসনে কৃষক দলের কেন্দ্রীয় নেতা হাসান জাফির তুহিনের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে আনোয়ারুল ইসলাম ও হাসাদুল ইসলাম হীরার সমর্থকরা বিক্ষোভ করেন। চাটমোহর বাজার ও বিভিন্ন এলাকায় তারা সমাবেশ করেন।
জয়পুরহাটেও একই চিত্র: সড়ক অবরোধ অব্যাহত
জয়পুরহাট-১ (সদর–পাঁচবিবি) আসনে মনোনয়ন পাওয়া মাসুদ রানা প্রধানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন আব্দুল গফুর মন্ডলের সমর্থকরা। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সড়ক অবরোধ করে তারা টানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন।
জয়পুরহাট-২ (কালাই–ক্ষেতলাল–আক্কেলপুর) আসনে সাবেক সচিব আব্দুল বারীর মনোনয়ন মেনে নিতে নারাজ বঞ্চিত সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফার অনুসারীরা। তারা একাধিক বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন।
কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ না থাকায় বাড়ছে ক্ষোভ
বিএনপির রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম বলেন, বিএনপি একটি বড় দল, যেখানে স্বাভাবিকভাবেই মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি। নীতিনির্ধারকরা অবদান বিবেচনায় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, "এখন সবচেয়ে জরুরি হলো—দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকা।"
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ—দলীয় উচ্চপর্যায়ের স্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় মাঠপর্যায়ে বিভক্তি বাড়ছে এবং সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
বিশেষ বিশ্লেষণ: জামায়াত লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা
বিএনপির অভ্যন্তরীণ এ সংকটের সুযোগ নিতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াত। বহু আসনে জামায়াতের ভোটব্যাংক উল্লেখযোগ্য। বিএনপি যদি বিভক্ত থাকে, তবে জামায়াত তুলনামূলক কম সংগঠিত অবস্থায়ও সুবিধা পেতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রাজশাহী বিভাগের প্রতিটি জেলায় তীব্র অসন্তোষ ও পালটাপালটি কর্মসূচি বিএনপির জন্য নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বড় চাপ ও ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজশাহী বিভাগজুড়ে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর যে অভ্যন্তরীণ সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা দলের নির্বাচনী সম্ভাবনাকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দ্রুত সমাধানে না গেলে প্রার্থী পরিবর্তন, দলীয় বিভাজন, সড়ক অবরোধ—সব মিলিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে, আর এর সুযোগ নিতে প্রস্তুত প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



