
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নানা প্রস্তুতি ও রাজনৈতিক তৎপরতা জোরদার হলেও, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে। বিশেষ করে গত বছরের জুলাই আন্দোলনের সময় লুট হওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র এখনো উদ্ধার না হওয়ায় নিরাপত্তা মহলে শঙ্কা বেড়েছে বহুগুণে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এসব অস্ত্রের মধ্যে এখনো প্রায় দেড় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠীর হাতে রয়ে গেছে, যা নির্বাচনকালীন শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
জুলাই আন্দোলনে নজিরবিহীন হামলা ও লুটপাট
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে দেশের ৫৭৪টি থানা ও ফাঁড়িতে সংঘটিত হামলা ও লুটপাটে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য ব্যবহৃত অস্ত্রের ভাণ্ডারে বড় ধরনের ধস নামে। হামলাকারীরা লুট করে নিয়ে যায় মোট ৫ হাজার ৭৫৩টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২ রাউন্ড গুলি। এর মধ্যে পিস্তল, রাইফেল, এসএমজি, শটগানসহ নানা ধরনের আধুনিক ও মারাত্মক অস্ত্র ছিল।
ঘটনার পর গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া অভিযানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার সম্ভব হলেও, তা এখনো পূর্ণাঙ্গ সাফল্য পায়নি। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ৪ হাজারের বেশি অস্ত্র এবং প্রায় ৪ লাখ রাউন্ড গুলি। অর্থাৎ, এখনও প্রায় দেড় হাজার অস্ত্র ও ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি গুলি অবৈধভাবে প্রচলনে রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সতর্ক বার্তা
সোমবার (১১ আগস্ট) স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তিনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। তিনি বলেন, “যতটা সম্ভব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, যদিও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি। আমরা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে তৎপর রয়েছি। যে তথ্য দিতে পারবে, তাকে আমরা পুরস্কারও দেবো।”
এ ঘোষণার মাধ্যমে সরকার অস্ত্র উদ্ধারে নতুন কৌশল হিসেবে পুরস্কার প্রদানের কথা ভাবছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এমন পদক্ষেপ দেরিতে নেওয়া হচ্ছে এবং তা দিয়ে খুব বেশি ফল পাওয়া সম্ভব হবে না।
ঢাকায় সবচেয়ে বেশি অস্ত্র লুট
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়েছে, জুলাই-আগস্টে রাজধানীর বিভিন্ন থানা ও পুলিশ স্থাপনা থেকে প্রায় ১ হাজার ৯০০টি অস্ত্র লুট হয়। ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, এর মধ্যে এক হাজার ২০০’র বেশি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, “নির্বাচনের আগে সুষ্ঠু ও সুন্দর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ আমরা নেবো। অস্ত্র উদ্ধারের জন্য পুরস্কারের ঘোষণা অবশ্যই ইতিবাচক উদ্যোগ, এতে তথ্যদাতারা সহযোগিতায় আগ্রহী হতে পারেন।”
বিশেষজ্ঞদের কড়া সতর্কতা
তবে সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অস্ত্র উদ্ধারে সময়ক্ষেপণ ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “এই অস্ত্রগুলো অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠীর কাছেই আছে, যারা এগুলোকে পুঁজি করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে বা অপরাধে ব্যবহার করবে। অনেক সময় এগুলো ভাড়ায়ও দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে এককভাবে অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া জরুরি।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এখন থেকে এক বছর আগে পুরস্কার ঘোষণা করা হলে হয়তো কিছুটা ফল পাওয়া যেত। কিন্তু যাদের হাতে এসব অস্ত্র আছে, তারা যেকোনো অঙ্কের পুরস্কারকেও উপেক্ষা করবে। তাই সমন্বিত এবং দ্রুত সামরিক অভিযান ছাড়া বিকল্প নেই।”
ভোটের আগে নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা
নির্বাচনকালীন সময়ে অস্ত্রবাহী অপরাধীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশাসনের অভ্যন্তরে যেমন উদ্বেগ রয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষের মাঝেও ভয় বিরাজ করছে। বিশেষ করে গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাস, খুন, ডাকাতি বা ভোটকেন্দ্রে হামলার শঙ্কা এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা বলছেন, সময় যত যাচ্ছে, অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা ততই কঠিন হয়ে উঠছে। কারণ, লুট হওয়া অনেক অস্ত্র পাচারের মাধ্যমে সীমান্ত পেরিয়ে যেতে পারে অথবা আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেটে বিক্রি হয়ে থাকতে পারে। আবার কিছু অস্ত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও ব্যবহার হতে পারে।
সব মিলিয়ে, সামনে জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, দেড় হাজারের বেশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার না হওয়া দেশের শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যদি সমন্বিত ও কৌশলগত অভিযান শুরু না হয়, তবে নির্বাচনের সময় সহিংসতার মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ