
ছবি: সংগৃহীত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হয়ে উঠেছে। নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুতি ত্বরান্বিত করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপি শুধু মিত্র রাজনৈতিক দল নয়, বরং ধর্মভিত্তিক ইসলামি দল ও সংগঠনগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই পদক্ষেপ আগামী নির্বাচনে জোট ও নির্বাচনি সমঝোতার রূপরেখা আরও স্পষ্ট করে দেবে।
বিএনপি ইতোমধ্যে খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, ছারছীনা দরবার শরিফ, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন এবং হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বিশেষভাবে হেফাজতে ইসলাম, ছারছীনা দরবার এবং জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকগুলো রাজনৈতিক মহলে গুরুত্ব পাচ্ছে। এর কারণ, এই সংগঠনগুলোর নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক রয়েছে এবং তারা আদর্শিকভাবে জামায়াতে ইসলামীর বিরোধী।
১ আগস্ট চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমদ। ওই দিন তাঁরা হাটহাজারীতে গিয়ে মরহুম আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী ও আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর কবর জিয়ারতও করেন। এর আগে ২৯ জুলাই ঢাকার বনানীতে ছারছীনা দরবার শরিফে গিয়ে পীর মুফতি শাহ আবু নছর নেছারউদ্দীন আহমাদ হুসাইনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় একান্তে কথা বলেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
সবশেষ ৮ আগস্ট ঢাকার মহাখালীতে গাউসুল আজম কমপ্লেক্সে মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সঙ্গে বৈঠক হয়। সংগঠনটির সভাপতি এএমএম বাহাউদ্দীন বৈঠকে জানান, তারা ২০ হাজার দরবার, ২০ হাজার প্রতিষ্ঠান ও ৫৫ লাখ ছাত্রছাত্রীর প্রতিনিধিত্ব করেন এবং সহিহ ইসলামের পক্ষে থাকবেন, তবে ইসলামকে দলীয় রাজনীতির জন্য ব্যবহার করবেন না।
স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, ইসলামপন্থি—সব ধরনের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। উদ্দেশ্য একটাই, বাংলাদেশের সব জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা করা। আমরা বিভক্তি চাই না, চাই ঐক্য।”
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব জানায়, যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের সঙ্গে নির্বাচনি পথে এগিয়ে যাবে দলটি। নির্বাচনে জিতলে জাতীয় সরকার গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে মিত্রদের মধ্যেই আসন বণ্টন হবে। এ প্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নেই, বরং জামায়াতবিরোধী ইসলামি দল ও সংগঠনকে পাশে রাখাই প্রধান লক্ষ্য।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহফুজুল করিম মনে করেন, বিএনপি কৌশলগত কারণে ইসলামি দলগুলোর দিকে ঝুঁকছে। “জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান এখন দুর্বল। বিএনপি চায় বিকল্প ইসলামি শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভোটের সমীকরণে প্রভাব ফেলতে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও মাদ্রাসা-প্রভাবিত এলাকায় এই কৌশল কার্যকর হতে পারে।”
অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, “হেফাজত বা জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মতো অরাজনৈতিক কিন্তু প্রভাবশালী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো নির্বাচনের আগে জনমত গঠনে সহায়ক হবে। তবে এ ধরনের সংগঠনের সমর্থন অর্জন করলেও তা ভোটে কতটা প্রতিফলিত হবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।”
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি পাঠানোর পর রাজনৈতিক অঙ্গনে যে সংশয় ছিল, তা কেটে গেছে। অনেক দল প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে পতিত হয়ে নিবন্ধন স্থগিত হওয়া আওয়ামী লীগ এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না—এটি বিএনপির জন্য বড় সুযোগ বলে মনে করছেন অনেকেই। ফলে বিএনপি বৃহৎ জোট গঠনে এগিয়ে থাকতে পারে এবং নির্বাচনি সমঝোতার মাধ্যমে আরও দলকে সঙ্গে টানতে পারে।
রাজনৈতিক মহলের হিসাব, ইসলামি দল ও সংগঠনের সমর্থন পেলে বিএনপির নির্বাচনি প্রচারণা শুধু ধর্মপ্রাণ ভোটারদের কাছেই নয়, বরং গ্রামীণ ভোটব্যাংকে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে, যেখানে এই সংগঠনগুলোর প্রভাব সুদৃঢ়, সেখানে ফলাফল নির্ধারণে এই সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
সব মিলিয়ে, বিএনপি নির্বাচনের আগে কৌশলগতভাবে এমন এক পথে হাঁটছে, যেখানে রাজনৈতিক মিত্রদের পাশাপাশি প্রভাবশালী ইসলামি সংগঠনগুলোও তাদের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় আগামী নির্বাচনে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ