
ছবি: সংগৃহীত
দেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিক সমাজ বর্তমানে এক গভীর সংকটের মুখোমুখি। সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চাঁদাবাজি ও প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্তমূলক প্রতিবেদনের কারণে সাংবাদিকরা ক্রমশ ভয়াবহ নির্যাতন, হামলা এবং প্রাণনাশের শিকার হচ্ছেন। সত্য তুলে ধরার পথে নানা বাধার সম্মুখীন এই পেশাজীবীরা এখন জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এই সংকটের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন দিক থেকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ, যা দেশের গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার তথা সাংবাদিক স্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
গত বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাত সাড়ে ৮টার দিকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় দৈনিক প্রতিদিনের স্টাফ রিপোর্টার আসাদুজ্জামান তুহিনকে সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে। হত্যার আগে তুহিন ফেসবুকে লাইভ প্রতিবেদন করছিলেন চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, যা হয়তো ছিল তার প্রাণের দাম। বৃদ্ধ পিতা মো. জামাল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার ছেলের কোনো অপরাধ ছিল না, আমি চাই সে ফিরুক।”
এতদিনে দেশে সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতার মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত এক বছরে মোট ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৩ জন দায়িত্ব পালনকালে হামলায় নিহত হলেও, তুহিন হত্যাকাণ্ডের পর নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চারজন। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ২৭৪টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার কারণে ১২৬ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) ও অধিকারের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
একই সময়, গত বছরের অক্টোবরে সন্ত্রাসী হামলায় আহত হন দৈনিক কালবেলার রূপগঞ্জ প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর মাহমুদ, যাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরের মধ্যে অন্যান্য বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে দলবদ্ধ ধর্ষণ, প্রাণনাশের হুমকি, অপহরণ ও বোমা হামলার শিকার হতে হয়েছে।
এইচআরএসএসের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে অন্তত ২০ জন সাংবাদিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন, ৩৪ জন হুমকির মুখে পড়েছেন, ১০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং অন্তত ২২টি মামলায় ৯২ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এর ভিত্তিতে অন্তত ১৬টি মামলায় সাংবাদিকদের জড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
পুলিশ ও সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি প্রকাশ করায়ও সাংবাদিকরা ক্রমাগত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি, বাংলা ট্রিবিউনের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি লিখন রাজকে ঘুষ দাবির একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) থেকে তাকে তলব করা হয়। লিখন রাজ জানান, এটি তথ্য যাচাইয়ের অংশ এবং কোনো ব্যক্তিগত হেনস্তা নয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (স্পেশাল ক্রাইম) মো. আশিক সাঈদ বলেন, “আমরা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। গাজীপুরে সাংবাদিক হত্যার ঘটনার তদন্ত চলছে এবং দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাংবাদিকদের ওপর এই সহিংসতার বৃদ্ধি দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য মারাত্মক সংকেত। মানবাধিকার সংগঠন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ (আসক) এর নির্বাহী পরিচালক বলেন, “সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত না হলে দেশ সত্য প্রকাশের স্বপ্ন থেকে বহু দূরে থাকবে।”
নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) গত বৃহস্পতিবার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর সরকারি আশ্বাস থাকা সত্ত্বেও গত এক বছরে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। বিবৃতিতে বলা হয়, মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ‘মব’ সৃষ্টি করে হুমকি প্রদানের সংস্কৃতি বন্ধ করা উচিত, কারণ এ ধরনের পরিস্থিতি গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল করে।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলি এই সংকট মোকাবিলায় সবার অংশগ্রহণ ও সহায়তার আহ্বান জানাচ্ছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক পর্যায়েও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য এক জাতীয় উদ্যোগ প্রয়োজন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় সাংবাদিকরা যেভাবে জীবন বাজি রেখে তথ্য প্রকাশ করছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন সক্রিয় পদক্ষেপ, যা বিনা দ্বিধায় সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে শক্তিশালী করবে এবং দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ