
ছবি: সংগৃহীত
দেশে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশাসন, নির্বাচন, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবী ছিল অন্যতম আলোচিত বিষয়। সেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন দীর্ঘদিন ধরে সুপারিশ প্রদান করে আসছে। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের শাসন ব্যবস্থায় উন্নয়ন ও স্বচ্ছতা আনার প্রত্যাশা ছিল।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের বাস্তবায়নে দৃঢ়তা দেখিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক বার্তায় জানানো হয়েছে যে, বিভিন্ন কমিশনের মোট ১৬টি সুপারিশ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটি দেশের সুশাসন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালীকরণে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাস্তবায়ন করেছে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয়েছে, যা বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং দ্রুতগতির নিশ্চয়তা দেয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়ন করে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে নির্বাচন আরও অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ থেকে ‘নাগরিকদের পাসপোর্ট পাওয়া মৌলিক অধিকার’ এবং ‘গণশুনানি’ এর মাধ্যমে প্রশাসনের পরিষেবা জনগণের কাছে সহজ ও দ্রুত পৌঁছানোর ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। পাসপোর্ট প্রক্রিয়ায় এই মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি পেলে নাগরিকদের দুর্ভোগ কমবে এবং সরকারি সেবা গ্রহণ আরও সুষ্ঠু হবে। পাশাপাশি গণশুনানির মাধ্যমে নাগরিকদের অভিযোগ, পরামর্শ ও দাবিকে সরকারি কর্মসূচিতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আওতায় অন্তর্বর্তী সরকার চারটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে তদন্ত-পূর্ব আবশ্যিক অনুসন্ধান-ব্যবস্থা বিলোপ, যা তদন্ত প্রক্রিয়াকে দ্রুততর ও কার্যকর করবে। এছাড়াও দুদক আইনের ধারা ৩২ক বিলোপ করে দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জটিলতা দূরীকরণ করা হয়েছে। উচ্চমাত্রার দুর্নীতি তদন্তে বিভিন্ন এজেন্সির সমন্বয়ে আলাদা টাস্কফোর্স গঠন এবং জাতীয় হিসাব পরিদর্শক (CAG) ও অডিট বিভাগের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে দুর্নীতি দমন ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও সমন্বিত করা হয়েছে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার আটটি সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ কমিশন গঠন, যা বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগ নিশ্চিত করবে। এছাড়াও আদালতে ইনফরমেশন ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে, যাতে বিচার প্রক্রিয়া আরও সহজ ও দ্রুত হয়। নারী ও শিশুদের জন্য আলাদা ও স্বতন্ত্র স্থান সংরক্ষণ করা হয়েছে, যা তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
বিচার বিভাগে আইনজীবীদের নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা দূরীকরণে সার্কুলার জারি, যা আইনগত কার্যক্রমকে আরও সহায়ক করবে। আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের সঙ্গে মধ্যস্থতা কার্যক্রম সংযুক্ত করা হয়েছে, যা মামলা পরিচালনায় সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। পাশাপাশি দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তি দ্রুততর করার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, যা বিচার ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করবে।
এই ১৬টি সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও বিচারবিভাগীয় কাঠামোতে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। এটি দেশের জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে প্রমাণ করে। তবে, এই পদক্ষেপগুলো ধারাবাহিকভাবে ও গভীরতা সহকারে সম্পাদিত হলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাবে এবং সুস্থ প্রজাতন্ত্র গঠনে অবদান থাকবে।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি, সমাজের বিভিন্ন স্তরের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে জনগণের সহমত ও সহযোগিতা আদায়ের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নশীল পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে গড়া এই সুপারিশ বাস্তবায়ন কর্মসূচি দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক সংস্কারে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। আগামীতে এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে, যা দেশের সব মানুষের কল্যাণ এবং সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ