
ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইলি হামলার লাগাতার নৃশংসতায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা উপত্যকার অবকাঠামো। সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছে গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। একদিকে অবরোধ ও হামলার কারণে অধিকাংশ হাসপাতাল অকেজো হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে রক্তের মজুদ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। অচল হয়ে পড়েছে ব্লাড ব্যাংকগুলো, ফলে চিকিৎসা নিতে আসা অসংখ্য রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসকরা বলছেন, রক্তের সংকট এতটাই প্রকট যে এখন অস্ত্রোপচার, দুর্ঘটনা কিংবা জরুরি রোগীর জন্যও প্রয়োজনীয় রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। বুধবার আল-জাজিরার এক বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির চিত্র।
গাজা সিটি থেকে আল-জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ জানিয়েছেন, গাজার মধ্যে বর্তমানে কার্যকর থাকা মাত্র কয়েকটি হাসপাতালের অবস্থা ভয়াবহ। আল-শিফা হাসপাতাল, আল-আকসা হাসপাতাল ও নাসের হাসপাতালে প্রতিদিনই রক্তের জন্য মরিয়া হয়ে অনুরোধ করছেন স্বজনরা। কিন্তু ব্লাড ব্যাংকগুলোর ভেতরে ঢুকেও ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে অধিকাংশ রক্তদাতাকে।
হানি মাহমুদের ভাষায়, “আমরা ব্লাড ব্যাংকে এমন বহু মানুষকে দেখেছি, যারা চোখে পানি নিয়ে চিকিৎসকের কাছে অনুরোধ করছিলেন—‘দয়া করে আমার রক্ত নিন, আমার ভাই বা সন্তানের জীবন বাঁচান।’ কিন্তু চিকিৎসকরা তাদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, দীর্ঘ সময় ধরে পানিশূন্যতা ও অনাহারে থাকার কারণে তাদের শরীরে রক্ত দেওয়ার মতো সক্ষমতা নেই।”
আল-শিফা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের প্রধান আমানি আবু ওউদা বলেন, “আমাদের কাছে আসা অধিকাংশ রক্তদাতা অপুষ্টিতে ভুগছেন। এ ধরনের শারীরিক অবস্থায় কেউ রক্ত দিলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন, যা তার নিজের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। একই সঙ্গে সংগ্রহ করা রক্তও কার্যকরভাবে ব্যবহারযোগ্য থাকবে না।”
তিনি আরও বলেন, “এই অবস্থায় প্রতিটি রক্ত ইউনিটই আমাদের জন্য অমূল্য। কিন্তু সুস্থ রক্তদাতার অভাবে সেই অমূল্য সম্পদও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস জানিয়েছেন, গাজায় এখনো অন্তত ১৪ হাজার ৮০০ এর বেশি রোগীর জরুরি ভিত্তিতে বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রয়োজন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্রুত মানবিক সহায়তা পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
গাজায় মানবিক সংকটের মধ্যেই নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে ইসরাইলি পরিকল্পনা নিয়ে। টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আগামী ৪-৫ মাসের মধ্যে গাজা পুরোপুরি দখলের পরিকল্পনা করেছেন। এই অভিযানে আইডিএফ-এর পাঁচটি ডিভিশন অংশ নেবে এবং গাজার পুরো ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হামাসকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করা। এর অংশ হিসেবে প্রায় ১০ লাখ গাজাবাসীকে জোরপূর্বক অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হতে পারে, যা ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে। তবে এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন ইসরাইলের সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়ায়েল জামির।
সেনাপ্রধান স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “পুরো গাজা দখল করা একটি ভুল পদক্ষেপ হবে। দখল মানে আমাদের সেনাদের স্থায়ীভাবে সেখানে থাকতে হবে—যা আসলে হবে একধরনের ফাঁদ। কারণ হামাস এখনো পুরোপুরি দুর্বল হয়নি। তাছাড়া হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের জীবনও মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “প্রায় দুই বছর ধরে অব্যাহত অভিযানের ফলে আমাদের সেনারা ক্লান্ত ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। অনেকেই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এখন আমরা রিজার্ভ সেনাদের নিয়ে কাজ চালাচ্ছি, ফলে দখলকৃত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।”
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ‘দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টির কারণে’ নতুন করে চারজন মারা গেছেন। এর মধ্যে একাধিক শিশু রয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুধাজনিত মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৭ জনে, যার মধ্যে ৯৬ জনই শিশু। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইলি অবরোধের কারণে অন্তত ১০০ জন অকাল জন্ম নেওয়া শিশু চরম ঝুঁকিতে আছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইলি হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬১,২৫৮ জনে, আর আহত হয়েছে অন্তত ১,৫২,০৪৫ জন। স্বাস্থ্যকর্মীদের মতে, পর্যাপ্ত রক্ত, ওষুধ এবং চিকিৎসা সামগ্রী পাওয়া না গেলে এই সংখ্যাগুলো আরও দ্রুত বাড়তে পারে।
গাজার বর্তমান পরিস্থিতি শুধু একটি অঞ্চলের মানবিক সংকট নয়—এটি পুরো বিশ্বের জন্য এক গভীর নৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন প্রশ্ন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কত দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এই রক্ত সংকট ও মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ