
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গত ৪ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একবছর পূর্তি অনুষ্ঠানের দিন ব্যক্তিগত সফর করার কারণে দলের শীর্ষ পাঁচ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। এই নোটিশের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের মূখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত বৃহস্পতিবার এ নোটিশের জবাব পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সেই সঙ্গে হাসনাত নিজেও তার জবাব ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন, যেখানে তিনি তার সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও দলের শোকজের সমালোচনা তুলে ধরেন।
হাসনাত আবদুল্লাহ তার ফেসবুক পোস্টে স্পষ্ট করেছেন, ৪ আগস্ট রাতে তিনি জানতে পারেন যে আন্দোলনের আহত ও নেতৃত্বদানকারী অনেক ভাইবোনদের ওই অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি তার কাছে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয় নয়, বরং নৈতিক ব্যর্থতা হিসেবেই মনে হয়েছে। তাই নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওই অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়ার। তার ভাষায়, ‘যেখানে ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজনকে, শহীদ ও আহতদের পরিবর্তে কিছু মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর কথা এবং মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, সেখানে উপস্থিত থাকার কোনো ইচ্ছা বা প্রয়োজন বোধ করিনি।’
হাসনাত আরও জানান, এই কারণে তিনি ঢাকার বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, তার ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ঐ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পূর্বে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো পুনর্বিবেচনা করা, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করা এবং ভবিষ্যতে করণীয় বিষয়ে চিন্তা করা। একইসঙ্গে, এই সফর ছিল ‘অসম্পূর্ণ জুলাই ঘোষণাপত্র’ এর প্রতি তার নীরব প্রতিবাদ।
হাসনাত আবদুল্লাহ উল্লেখ করেন যে, ৪ আগস্ট রাতে তার ও অন্যান্য নেতাদের ভ্রমণের বিষয়টি এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে থাকা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর মাধ্যমে দলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদ ইসলামকে অবগত করা হয়। তার কথায়, ‘আমাদের পার্টির উচিত ছিল গোয়েন্দা সংস্থা ও অসৎ মিডিয়ার বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু তার পরিবর্তে পার্টি আমাদের বিরুদ্ধে এমন ভাষায় শোকজ দিয়েছে, যা মিথ্যা অভিযোগ ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে উসকে দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, পার্টির গঠনতন্ত্রের কোনো ধারা লঙ্ঘনের কথা কারণ দর্শানোর নোটিশে উল্লেখ করা হয়নি। এটি স্পষ্টতই নেতাদের ভুল বোঝাবুঝি ও রাজনৈতিক গুজবের ফলাফল। এনসিপির শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগত সফরকে কেন্দ্র করে যেভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তা দলের ভাবমূর্তি ও ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর।
গত এক বছর ধরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নানা ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া এনসিপি বর্তমানে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নামে পরিচিত একটি কর্মসূচির বাস্তবায়ন ও সমর্থনে কাজ করে যাচ্ছে। ৪ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান দিবসে অনুষ্ঠিত স্মরণসভা ও কর্মসূচিতে যোগ না দিয়ে হাসনাতের এই সফর দলের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্ন ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। যদিও তার ব্যক্তিগত বক্তব্য দলীয় শৃঙ্খলার বাইরে নয়, তথাপি নোটিশের মাধ্যমে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়াস নেওয়া হয়।
হাসনাতের মত অনুযায়ী, দলকে উচিত ছিল বিভাজনের বদলে ঐক্যের মাধ্যমে সকল নেতাকর্মীকে যুক্ত করা এবং অন্যায় গুজব মোকাবেলায় কঠোর অবস্থান নেয়া। তাঁর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বা অনুপস্থিতি ব্যক্তিগত মতামত ও নৈতিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে, যা দলের সম্মিলিত চিন্তাধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এনসিপির এই ঘটনার মাধ্যমে দলের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিচালনার বিষয়গুলো স্পষ্ট হচ্ছে। কোনো দলের নেতৃত্ব যখন কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়, তখন একক নেতার ব্যক্তিগত মতামত ও দলের সমন্বয় বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক অঙ্গনে ঐক্যের অভাব বা বিভাজন পরবর্তীতে দলীয় কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এনসিপির উচিত দলীয় একতাকে শক্তিশালী করা এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে দল নির্বাচনমুখী প্রস্তুতিতে মনোনিবেশ করতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ পরবর্তী সময় থেকে এনসিপি ও অন্যান্য দলগুলোর মাঝে নানা চ্যালেঞ্জ ও আলোচনার জোয়ার লক্ষ্য করা গেছে। এ সময়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচির প্রতি দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে।
হাসনাত আবদুল্লাহর এই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ও দলের প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের নৈতিক ও আদর্শিক দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আগামী দিনে দলীয় ঐক্য রক্ষা এবং সুশৃঙ্খল কর্মপরিকল্পনা গ্রহণেই এনসিপির স্থিতিশীলতা ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সর্বশেষ, এনসিপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সমঝোতা ও পারস্পরিক সম্মানের মধ্য দিয়ে দলীয় গঠন ও কর্মসূচি আরও সুসংহত করতে পারলেই দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে এনসিপির কার্যকারিতা বাড়বে এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ