
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও দলীয় নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগে দলের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ নেতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে পার্টির কেন্দ্রীয় দপ্তর। আজ বুধবার (৬ আগস্ট) এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত স্বাক্ষরিত একাধিক পৃথক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই পাঁচ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়।
এই পাঁচজন নেতার মধ্যে রয়েছেন এনসিপির কেন্দ্রীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সংগঠনের নেতৃত্বের দায়িত্বে থাকা নেতৃবৃন্দ। তাঁরা হলেন:
১. নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী – এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক
২. সারজিস আলম – মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল)
৩. হাসনাত আবদুল্লাহ – মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল)
৪. তাসনিম জারা – জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব
৫. খালেদ সাইফুল্লাহ – যুগ্ম আহ্বায়ক
নোটিশ অনুযায়ী, গত ৫ আগস্ট এই পাঁচ নেতা ব্যক্তিগত সফরে কক্সবাজারে গমন করেন, তবে এই সফরের বিষয়ে দলীয় ফোরাম বা সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে পূর্বে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক অবহিত করা হয়নি। এই সফরকে ঘিরে দলের অভ্যন্তরে নানা প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ায় কেন্দ্রীয় দপ্তর বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের এ ধরনের সফর, বিশেষ করে একসঙ্গে একাধিক শীর্ষ নেতার উপস্থিতি, কেবল ব্যক্তি পর্যায়ের বিষয় নয়—এতে দলের ভাবমূর্তি ও অভ্যন্তরীণ সংগঠনগত ভারসাম্যের ওপরও প্রভাব পড়ে। দল মনে করছে, এ ধরনের আচরণ দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক এবং এটি দলীয় শৃঙ্খলা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কারণ দর্শানোর নোটিশে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সফরের সিদ্ধান্ত, প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে হবে। সেই সঙ্গে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই পাঁচ নেতাকে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং সদস্যসচিব আখতার হোসেনের সামনে সরাসরি হাজির হতে বলা হয়েছে। দলের দপ্তর বিভাগ মনে করছে, এই ঘটনায় ব্যাখ্যা না দিলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে পরবর্তী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার অভিমত, সাম্প্রতিক সময়ে এনসিপির বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তে অস্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে, যার ফলে কিছু নেতার আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। দলীয় ফোরামে এই সফর নিয়ে পূর্ব আলোচনা না থাকা সত্ত্বেও একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার হঠাৎ একই স্থানে যাওয়ার ঘটনা 'ব্যতিক্রমী ও অনাকাঙ্ক্ষিত' হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দলীয় বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনার ফলে এনসিপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনপূর্ব সময়কে ঘিরে যখন অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এক ধরনের পুনর্গঠন ও কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত, তখন এমন ঘটনা দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও শৃঙ্খলার জন্য অশনিসংকেত হতে পারে।
একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছ থেকে স্বচ্ছতা ও যোগাযোগে সতর্কতা প্রত্যাশিত বলে দলীয় নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে। ফলে দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরের এই পদক্ষেপকে অনেকেই 'কঠোর কিন্তু প্রয়োজনীয়' হিসেবে দেখছেন।
তবে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আপাতত এই পাঁচ নেতার কাউকেই সরাসরি বহিষ্কারের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। তাদের ব্যাখ্যার পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং ঐক্য ধরে রাখার স্বার্থে নেতাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হলেও, আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করতে চায় নেতৃত্ব।
সামনের জাতীয় নির্বাচন, রাজনৈতিক বাস্তবতা ও দলীয় পুনর্গঠনের গুরুত্বপূর্ণ সময়কে সামনে রেখে এনসিপি একটি সক্রিয় ও কার্যকর অবস্থানে যেতে চাইছে। এরই মধ্যে, দলীয় গঠনপুনর্গঠন, জেলা পর্যায়ে নেতৃত্ব বাছাই, রাজনৈতিক মিত্রতা—সবকিছু মিলিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিক্রম করছে দলটি। এই প্রেক্ষাপটে, শীর্ষ নেতাদের এ ধরনের সমন্বয়হীন সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক কৌশলে প্রভাব ফেলতে পারে বলে অভিমত দলের অভ্যন্তরের অনেকের।
জাতীয় নাগরিক পার্টির সাম্প্রতিক এই পদক্ষেপ শুধু একটি সফরকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা চাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি দলীয় শৃঙ্খলা, জবাবদিহি ও নেতৃত্বের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার এক বার্তা। এটি দলের অন্যান্য নেতাকর্মীদের মধ্যেও একটি স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে—দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণ করলে তার জবাবদিহি করতে হবে।
দলীয় ঐক্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এই ধরনের নজির স্থাপন ভবিষ্যতের জন্য গঠনমূলক বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ