
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে চাঞ্চল্য তৈরি করেছে কক্সবাজার সফরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) চার শীর্ষ নেতার উপস্থিতি এবং তাদের ‘গোপন বৈঠকের’ সম্ভাবনা। মঙ্গলবার দুপুরে হঠাৎ করেই তারা জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা কক্সবাজারে পৌঁছান, এবং এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা ও গুজব ছড়িয়ে পড়ে—বিশেষ করে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে সম্ভাব্য এক বৈঠক ঘিরে।
যদিও সংশ্লিষ্ট নেতারা দাবি করছেন, এই সফর একেবারেই ‘ব্যক্তিগত’ এবং ‘বিশ্রামের উদ্দেশ্যে’, তবে ঘটনাপ্রবাহ, সফরের ধরন ও সময়চক্র বিশ্লেষণ করলে এটি নিছক একটি ঘুরতে আসা বলেই সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে না।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর যে চারজন শীর্ষ নেতা হঠাৎ কক্সবাজারে এসেছেন তারা হলেন— তাসনিম জারা, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম ও নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
তাদের আগমনের সময় ছিল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে। জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তাঁরা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।
বিমানবন্দরে কর্মরত একাধিক ফ্লাইট এজেন্সির কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা এনসিপি নেতাদের আগমনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাদের ভাষায়, নেতারা খুবই চুপিসারে এসেছেন, এবং গণমাধ্যম বা স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছাড়াই সরাসরি হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
তাদের গন্তব্য ছিল কক্সবাজারের ইনানী সৈকতের পাশেই অবস্থিত অভিজাত পাঁচ তারকা হোটেল ‘সী পার্ল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’ (রয়েল টিউলিপ)। হোটেল সূত্রে জানা যায়, কোনো পূর্ব বুকিং বা ঘোষণা ছাড়াই দুপুর ১২টার পর হোটেলে প্রবেশ করেন তারা।
রয়েল টিউলিপের এক কর্মকর্তা, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে, জানান— “প্রথমে আমরা জানতেও পারিনি। নেতারা খুব গোপনে এসেছেন। কোনো সাংবাদিক বা স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিকে খবর দেননি। এভাবে হঠাৎ করে কেউ আসা মানে সাধারণত কিছু না কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা-বার্তা বা বৈঠকের ইঙ্গিত দেয়।”
গুজবের কেন্দ্রে রয়েছেন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি উঠেছে, এনসিপি নেতারা মূলত তাঁর সঙ্গেই বৈঠক করতে এসেছেন।
রয়েল টিউলিপের আরেক কর্মকর্তা বলেন, “হোটেলে একজন বিদেশিকে দেখা গেছে, যার চেহারা পিটার হাসের সঙ্গে অনেকটাই মিল। তবে তিনি আদৌ পিটার হাস কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।”
তবে বিমানবন্দর সূত্র বলছে, পিটার হাস গত ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ ছেড়েছেন। এরপর থেকে তাঁর আবার বাংলাদেশে প্রবেশের কোনো সরকারি তথ্য বা রেকর্ড নেই। ফলে গুঞ্জনের বাস্তবতা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে।
অন্য একটি কূটনৈতিক সূত্র থেকে জানা গেছে, এনসিপি নেতারা আসলে পিটার হাসের নাম সামনে রেখে কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেছেন বা করতে যাচ্ছেন। ঠিক কোন দেশের প্রতিনিধি, বা কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে—সে বিষয়ে কেউ স্পষ্ট করে কিছু বলতে রাজি হননি।
গুজব ও আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন এনসিপির অন্যতম নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এক প্রতিক্রিয়ায় দাবি করেন, পুরো বিষয়টি গুজব এবং ভিত্তিহীন। তিনি বলেন— “কারো সঙ্গে দেখা করতে নয়, হুট করে ঘুরতে আসছিলাম। পদযাত্রাতে টায়ার্ড হয়ে গেছিলাম। জাস্ট এমনে একটু সাগর পাড়ে ঘুরতে আসছিলাম। বাট এখানে আইসা দেখি, হোটেলে চেক ইন করে মাত্র বসছি, এর মধ্যেই এ নিউজ দেখতেছি।”
তাঁর এই মন্তব্য ঘিরেও নতুন করে আলোচনা শুরু হয়, কারণ একজন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা, তাও চারজন মিলে, কোনো আগাম ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ করে কক্সবাজার আসবেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে গুজব ছড়াবে—এটি নিছক ‘ভ্রমণ’ হিসেবে বিবেচনা করা অনেকের কাছে কঠিন মনে হচ্ছে।
সূত্র বলছে, এনসিপি নেতারা কক্সবাজারে দীর্ঘ সময় থাকবেন না। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টার ফ্লাইটেই তাদের কক্সবাজার ছাড়ার কথা। এ অল্প সময়ের সফর এবং নির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি বা লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ ছাড়া হোটেলে অবস্থান—সবই একটি গোপন বৈঠকের ইঙ্গিত বহন করছে বলেই পর্যবেক্ষকদের মত।
এনসিপির হঠাৎ কক্সবাজার সফর, তাও একসঙ্গে চার শীর্ষ নেতার উপস্থিতি, অভিজাত হোটেলে নির্দিষ্ট সময়ের অবস্থান এবং সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নাম ঘিরে গুঞ্জন—সব মিলিয়ে বিষয়টি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে উত্তাপ ছড়িয়েছে।
যদিও এখনো কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠকের কথা স্বীকার করেনি বা নিশ্চিত তথ্য দেয়নি, তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—সাম্প্রতিক সময়ের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ডাইনামিকস বিবেচনায়, এমন গোপনীয় সফরের গুরুত্ব অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ