ছবি: সংগৃহীত
রাজস্ব প্রশাসন পুনর্গঠনের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ—জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি’ এবং ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ নামে দুটি নতুন বিভাগ গঠনের কার্যক্রম—চলতি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকালেই বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই সব প্রয়োজনীয় আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শেষ করা সম্ভব হবে এবং দুটি নতুন বিভাগের দায়িত্বে দুইজন সচিব বসার মতো প্রশাসনিক কাঠামোও তৈরি হয়ে যাবে।
সোমবার (৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের এক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় থাকা করনীতি ও করব্যবস্থাপনার পৃথকীকরণ সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া প্রায় পুরোপুরি সম্পন্ন। এখন চলছে বাস্তবায়নের সূক্ষ্ম দাপ্তরিক কাজ—যা সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের কর প্রশাসন কাঠামোতে এক নতুন যুগের সূচনা হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “পলিসি ও ট্যাক্স ম্যানেজমেন্টের সেপারেশন—এটার আইনি প্রক্রিয়া অলমোস্ট শেষ। এখন হচ্ছে বাস্তবায়ন। ‘অ্যালোকেশন অফ বিজনেস’ প্রায় চূড়ান্ত, ‘রুলস অফ বিজনেস’ও প্রায় প্রস্তুত। অর্গানোগ্রাম, পদের কাঠামো, দায়িত্ববণ্টন—সব কিছুর খসড়া সম্পন্ন হয়ে গেছে। শুধু চূড়ান্ত অনুমোদনের কয়েকটি ধাপ বাকি।”
তিনি আশা প্রকাশ করেন—যদি পরিকল্পনামাফিক অগ্রগতি অব্যাহত থাকে, তাহলে এই ডিসেম্বরেই দুটি নতুন বিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করতে পারবে। অর্থাৎ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েই ‘রাজস্ব নীতি’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ বিভাগের সচিবরা দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
নতুন কাঠামো বাস্তবায়ন হলে কর প্রশাসনের অচলাবস্থা, কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও বহু বছরের অভিযোগের সমাধান মিলবে বলে আশা করছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। তাঁর ভাষায়, “দুই বিভাগ হলে স্বাধীনভাবে কর নীতি প্রণয়ন সম্ভব হবে। দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি এবং করদাতাদের স্বার্থকে মাথায় রেখে নীতি নির্ধারণ করা যাবে। এতে রেভিনিউ বাড়বে—সঙ্গে ইনজাস্টিস, বৈষম্য এসবও কমবে।”
তাঁর মতে, কর নীতি তৈরির কাজ ও কর আদায়ের কাজ আলাদা হওয়া উন্নত করব্যবস্থাপনার অপরিহার্য অংশ। অনেক উন্নত দেশে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, বাংলাদেশও ধীরে ধীরে সেই মডেলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
এ বছরের ১২ মে সরকার ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে এনবিআর বিলুপ্ত ঘোষণা করে। পুরনো কাঠামো থেকে বেরিয়ে দুটি স্বাধীন বিভাগ গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বড় ধরনের অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
পরদিন থেকেই শুরু হয় অবস্থান কর্মসূচি, কলমবিরতি, মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ নানা আন্দোলন। তাদের দাবি ছিল—
-
এনবিআরের শীর্ষ পদে প্রশাসন ক্যাডারের সচিব নিয়োগ নয়
-
বরং বিসিএস (কর) ও বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের দীর্ঘ অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে
-
রাজস্ব খাতের বিশেষায়িত কাজ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের হাতে গেলে দক্ষতা ও ধারাবাহিকতায় সমস্যা সৃষ্টি হবে
কর্মকর্তাদের এই আন্দোলনের কারণে প্রশাসনিক কাজ কিছুদিন স্থবির হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে সরকার অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন থেকে আপাতত সরে এসে সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দেয়।
এই আন্দোলনে নেতৃত্ব ও সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে এনবিআরের শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী সাময়িক বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর ও শাস্তিমূলক বদলির মুখোমুখি হন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করে। রাষ্ট্রীয় রাজস্ব প্রশাসনে এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা অভূতপূর্ব।
পরবর্তীতে কর্মীদের দাবির মুখে সরকার অধ্যাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে। সংশোধিত ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এ মোট ১১টি পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল—
-
নতুন দুই বিভাগের শীর্ষ পদে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগের বিধান যুক্ত করা
এর মাধ্যমে বিসিএস কর ও শুল্ক-ক্যাডারের জন্য শীর্ষ নেতৃত্বে অংশগ্রহণের পথ উন্মুক্ত হয়।
দুটি নতুন বিভাগ গঠনের মূল উদ্দেশ্য—
-
কর নীতি নির্ধারণকে গবেষণাভিত্তিক ও স্বাধীন করা
-
কর ব্যবস্থাপনা ও কর আদায়কে প্রযুক্তিনির্ভর ও দক্ষ করা
-
নীতি ও বাস্তবায়নের স্বার্থসংঘাত দূর করা
-
কর জালিয়াতি, দুর্নীতি ও রাজস্ব ঘাটতি কমানো
তবে নতুন কাঠামো কার্যকর করতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে—
-
বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদায়ন ও পুনর্বিন্যাস
-
কর তথ্যভাণ্ডার একীভূতকরণ
-
আইটি অবকাঠামো সম্প্রসারণ
-
দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক সংস্কৃতির পরিবর্তন
সরকারি সূত্র বলছে, নীতি বিভাগ হবে তুলনামূলক ছোট ও দক্ষতানির্ভর; গবেষণা, নীতিমালা প্রণয়ন, রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট ও বৈদেশিক সহযোগিতা তদারকি করবে। অন্যদিকে, ব্যবস্থাপনা বিভাগ হবে বৃহত্তর—যারা মাঠপর্যায়ের কর আদায়, শুল্ক নিয়ন্ত্রণ, আমদানি-রপ্তানি, মূল্যায়ন ও অডিট পরিচালনা করবে।
বাংলাদেশের রাজস্ব জিডিপি অনুপাত বহু বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে ঋণনির্ভরতা বাড়ছে। ফলে রাজস্ব কাঠামোতে বড় ধরনের সংস্কার দীর্ঘদিন ধরে সময়ের দাবি ছিল। এনবিআর বিলুপ্তি এবং দুটি পৃথক বিভাগ গঠনকে এ কারণে অনেক অর্থনীতিবিদ ‘স্ট্রাকচারাল রিফর্মের যুগান্তকারী পদক্ষেপ’ বলে মনে করছেন।
তাদের মতে—যদি এই পরিবর্তন বাস্তবায়ন সঠিকভাবে করা যায়, তাহলে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, ব্যবসাবান্ধব করনীতি, এবং স্বচ্ছ প্রশাসনের দিকে একটি বড় অগ্রগতি হতে পারে।
সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ডিসেম্বরের মধ্যেই বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন রাজস্ব প্রশাসন কাঠামোয় প্রবেশ করবে—যেখানে একই ছাদের নিচে থাকা নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব দূর হবে। কর নীতি হবে স্বাধীন; আর কর আদায় হবে আধুনিক পদ্ধতিতে, আলাদা দক্ষ প্রশাসনের মাধ্যমে পরিচালিত।
এনবিআর চেয়ারম্যানের ভাষায়, “দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, ব্যবসার স্বার্থে নীতি প্রণয়ন হবে। এতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে, বৈষম্য কমবে এবং রাজস্বও বাড়বে।”
বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে, তখন এই পুনর্গঠন—রাজস্ব প্রশাসনের ভবিষ্যৎকে পুনর্নির্ধারণ করার এক বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



