ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩। এতদিন এই আইনেই চলছিল অভিযুক্তদের বিচার। ৫ আগস্ট (জুলাই বিপ্লব-২০২৪) পট পরিবর্তনের পর আইনটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বিশেষ কিছু সংশোধনী এসেছে আইনে। দৃষ্টিনন্দন ও ব্যবহার উপযোগী করে মেরামত করা হয়েছে ট্রাইব্যুনাল ভবনও। এখানে হবে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বিচার।
শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে গণহত্যা চালিয়েছেন। দোসর হিসেবে কাজ করা হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য, উপদেষ্টাগণ, ১৪ দলীয় জোটের নেতারা, সাবেক সচিবরা, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতিরা, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে।
সংশোধিত অধ্যাদেশে-২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। এ ছাড়াও প্রথমবার গুমের অভিযোগ বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। তবে এতে দলের বিচারের বিষয়টি রাখা হয়নি
গেল ২৪ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস অধ্যাদেশ, ২০২৪’ করা হয়।
এ ব্যাপারে প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন জানিয়েছিলে, ‘এই আইন সংশোধন করে আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়েছে। আইনে যেসব দুর্বলতা ছিল ও আন্তর্জাতিকভাবে যে প্রশ্নগুলো আইনটি সম্পর্কে তোলা হতো, সেসবের সমাধান করে এই সংশোধনী আনা হয়েছে।’
প্রসিকিউটর বলেন, ‘ডিফেন্সকে প্রস্তুতের জন্য আগে আসামিরা ৩ সপ্তাহ সময় পেতেন। এখন আসামিরা ৬ সপ্তাহ সময় পাবেন। পূর্বে প্রসিকিউশন সীমিত নথিপত্র ডিফেন্সকে দিতে পারতেন; এখন যেকোনও নথিপত্র চাইলে আদালত সেগুলো দেবে।
পূর্বে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে আইনটি দিয়ে বিচার করা যেত। এখন ৩ বাহিনীর ছাড়াও বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও আনসারকেও এই আইনে বিচার করা যাবে।
গাজী মোনাওয়ার হুসাইন বলেন, এই আইনে রাজনৈতিক দল কিংবা সংগঠনকে বিচারের আওতায় আনা যাবে না। বিধান রাখা হয়নি। তবে অন্য আইনে তাদের বিচার করার বিধান আছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের নতুন সংশোধনীতে উল্ল্যেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো
- নতুন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করেও কোনো ব্যক্তির অপরাধ যদি এই আইনেও আওতায় পড়ে তবে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা যাবে।
- এখন ৩ বাহিনীর ছাড়াও বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও আনসারকেও এই আইনে বিচার করা যাবে।
- অপরাধের সংজ্ঞায় (ধারা ৩)-এ মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞাটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ডের মতো করে, বিশেষত ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)-এর সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যার আলোকে সাজানো হয়েছে, এবং অপরাধ হিসেবে বিদ্যমান অপরাধের সাথে সাথে এনফোর্সড ডিজ্যাপিয়ারেন্স (গুম), মানব পাচার, যৌন নির্যাতন, যৌন দাসত্ব এগুলো যুক্ত করা হয়েছে। একই সাথে, অপরাধের জন্য দায়বদ্ধতার ধারাটি (ধারা ৪) আরও বিস্তৃত করা হয়েছে।
- নতুন সংশোধনীর আলোকে, আদালত চাইলে বিচারিক প্রক্রিয়ার অডিও-ভিডিও রেকর্ড করতে পারবেন এবং প্রয়োজন মনে করলে তা অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারের নির্দেশনাও দিতে পারবেন। জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনসমূহের প্রতিনিধিরা বিচারিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। ভিকটিম ও সাক্ষীদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনে ভার্চ্যুয়াল শুনানি ও সাক্ষ্যগ্রহণের সুযোগও থাকবে। বার কাউন্সিলের অনুমোদন সাপেক্ষে বিদেশি আইনজীবীরা শুনানিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
- একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হচ্ছে, যদি এই আদালতে কোনো অভিযোগ আসার পর দেখা যায় যে, এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ বা গণহত্যার অভিযোগ নয়, সেক্ষেত্রে সেই মামলা যথাযথ আদালতে বিচারের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া যাবে।
- নতুন সংশোধনীতে আসামির অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ আনা হয়েছে। আসামিপক্ষ প্রসিকিউশনের কাছ থেকে বিভিন্ন সাক্ষ্যপ্রমাণ ও ডকুমেন্ট পাওয়ার অধিকারী হবে (ম্যান্ডেটরি ডিসক্লোজার)। এ ছাড়া আসামিপক্ষ তাদের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় সময় ও সুবিধা পাবেন এবং গ্রেপ্তারকালীন অবস্থায় কোনো ধরনের নির্যাতন (কাস্টোডিয়াল টর্চার) থেকে আইনানুগ সুরক্ষা পাবেন।
- এই আইনের সবচেয়ে বেশি সমালোচিত সাক্ষ্য সংক্রান্ত পুরনো বিধানটি (ধারা ১৯ এর ১) বাতিল করে নতুন বিধান আনা হয়েছে, যেখানে সিসি ক্যামেরা, ড্রোন ফুটেজ, মোবাইল ফোনের ডেটা ইত্যাদি সর্বাধুনিক ডিজিটাল সাক্ষ্যসহ কোন কোন বিষয় বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য হিসেবে আনা যাবে—তার সুস্পষ্ট এবং বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা চ্যালেঞ্জ করার বিধান রাখা হয়েছে এবং ট্রাইব্যুনাল যদি কোনো সাক্ষ্যকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করে, সেক্ষেত্রে সেটি আর বিচারিক প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে না। এর পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বিধান লঙ্ঘন করে সংগৃহীত কোনো সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না, বিশেষত যদি এই ধরনের সাক্ষ্য বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
- নতুন সংশোধনীতে ভিকটিমদের জন্য ক্ষতিপূরণের বিধান রাখা হয়েছে। এই ক্ষতিপূরণ অপরাধী (দণ্ডিত) ব্যক্তি নিজে দেবেন বা তাদের সম্পদ থেকে আদায় করা হবে বা রাষ্ট্র বহন করবে। এছাড়া ভিকটিম এবং সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে ট্রাইব্যুনাল আদেশ দিতে পারবেন। আর ট্রাইব্যুনালের আদেশ অমান্য করা হলে যদি আদালত অবমাননার দায়ে কারো বিরুদ্ধে কোনো আদেশ হয়, এই আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে অন্তর্বর্তীকালীন আপিল করা যাবে। তবে আপিল বিভাগে আবেদন পেন্ডিং থাকলে ট্রাইব্যুনাল মামলা চালিয়ে যেতে পারবেন যেন কোনো ধরনের অযাচিত বিলম্ব না হয়।
বাংলাবার্তা/এমআর
.png)
.png)
.png)



