
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) প্রকাশ করেছে জুলাই ২০২৫-এর 'মেনস প্লেয়ার অব দ্য মান্থ' বা মাসসেরা পুরুষ ক্রিকেটারের সংক্ষিপ্ত তালিকা। এবার এই প্রতিযোগিতায় জায়গা করে নিয়েছেন তিন ফর্মে দুর্দান্ত পারফর্ম করা তিন তারকা—ভারতের তরুণ অধিনায়ক শুভমন গিল, ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার ও অধিনায়ক বেন স্টোকস এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন টেস্ট অধিনায়ক উইয়ান মুলডার।
তিনজনই সদ্য শেষ হওয়া লাল বলের সিরিজে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে অসাধারণ ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন, যা আইসিসির র্যাঙ্কিং ও মাসসেরা বিবেচনায় এনে দিয়েছে তাদের এই মনোনয়ন।
শুভমন গিল: ইংল্যান্ডে ব্যাটিং দাপটে উজ্জ্বল ভারতের তরুণ অধিনায়ক
মাত্র ২৫ বছর বয়সেই ভারতীয় টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব পাওয়া শুভমন গিল তার প্রথম সিরিজেই প্রমাণ করে দিয়েছেন, নেতৃত্ব কাঁধে থাকলেও ব্যাটে ধার কমে না। ইংল্যান্ড সফরে অনুষ্ঠিত পাঁচ ম্যাচের ঐতিহাসিক সিরিজে গিল ব্যাট হাতে ছিলেন সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ফর্মে।
তিনটি টেস্টে ৯৪.৫০ গড়ে মোট ৫৬৭ রান করেছেন তিনি। এর মধ্যে এজবাস্টনে প্রথম ইনিংসে ২৬৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ১৬১ রানে ইনিংস ছিল গোটা সিরিজের অন্যতম আলোচিত পারফরম্যান্স।
এরপর চতুর্থ টেস্টে ওল্ড ট্রাফোর্ডে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে আরও এক সেঞ্চুরি—১০৩ রান। গিলের এসব ইনিংস কেবল ব্যক্তিগত রেকর্ডই নয়, বরং ভারতের জন্য সিরিজের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে বড় ভূমিকা রেখেছে। শেষ পর্যন্ত সিরিজটি ড্র হয় ২-২ ব্যবধানে।
অধিনায়ক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ছিল আত্মবিশ্বাসী, পরিণত এবং রানসমৃদ্ধ। লর্ডস ও ওল্ড ট্রাফোর্ডে মাঠে তার নেতৃত্ব এবং ব্যাটিং অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে, গিল এই মুহূর্তে বিশ্ব ক্রিকেটে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল এবং ভয়ঙ্কর ব্যাটসম্যানদের একজন।
বেন স্টোকস: দুই হাতে ইংল্যান্ডকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নেতার নাম
ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার বেন স্টোকস এখনও দলকে টানছেন সামনে থেকে। সদ্য শেষ হওয়া অ্যান্ডারসন-টেন্ডুলকার ট্রফির পাঁচ ম্যাচের সিরিজে তিনটি টেস্টে অংশ নিয়ে স্টোকস ছিলেন ব্যাট ও বল হাতে সমান কার্যকর।
ব্যাট হাতে ৫০.২০ গড়ে ২৫১ রান এবং বল হাতে ২৬.৩৩ গড়ে ১২ উইকেট—একজন অলরাউন্ডারের যা প্রয়োজন, সেটিই করেছেন স্টোকস। বিশেষ করে লর্ডস ও ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে তার প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো।
ওল্ড ট্রাফোর্ডে তার ১৪১ রানের অনবদ্য ইনিংস ইংল্যান্ডকে ৬৬৯ রানের বিশাল সংগ্রহ এনে দেয়। ম্যাচসেরা হন টানা দুই টেস্টে।
এই সিরিজে তিনি প্রমাণ করেছেন, বয়স বা অভিজ্ঞতা যতই হোক, খেলার প্রতি দায়বদ্ধতা এবং আগ্রাসী মানসিকতা তার এখনও অটুট। স্টোকসের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড শেষ পর্যন্ত সিরিজ ড্র করতে সক্ষম হয়, যা দলের আত্মবিশ্বাসে নতুন রক্ত সঞ্চার করেছে।
উইয়ান মুলডার: ব্যাটিং বিস্ফোরণে নতুন ইতিহাস গড়া অধিনায়ক
দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন টেস্ট অধিনায়ক উইয়ান মুলডার অনেকটা নীরবেই বিশ্ব ক্রিকেটকে চমকে দিয়েছেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সদ্য শেষ হওয়া দুই টেস্টের সিরিজে তিনি করেছেন এমন কিছু, যা দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে আগে দেখা যায়নি।
মাত্র দুই ম্যাচে মুলডার রান করেছেন ৫৩১, গড় ২৬৫.৫০! প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেছেন ১৪৭ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস। তবে আসল চমক ছিল দ্বিতীয় টেস্টের বুলাওয়ে ইনিংসে, যেখানে তিনি খেলেছেন অপরাজিত ৩৬৭ রানের এক বিশাল ইনিংস—যা দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে টেস্টে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান।
এই রেকর্ড ইনিংস তার ব্যাটিং প্রতিভার প্রমাণ। শুধু ব্যাটেই নয়, বল হাতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ১৫.২৮ গড়ে নিয়েছেন ৭ উইকেট, যার মধ্যে প্রথম টেস্টে শিকার করেছেন ৪টি উইকেট।
মুলডারের এই অলরাউন্ড পারফরম্যান্স তাকে শুধু মাসসেরা মনোনয়নই নয়, ভবিষ্যতের এক ভয়ঙ্কর টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে।
বিশ্লেষণ ও প্রত্যাশা
জুলাই মাসে এই তিন ক্রিকেটারের পারফরম্যান্সই ছিল নজরকাড়া, কিন্তু কার জয় হবে ‘মাসসেরা’ খেতাব—তা নিয়ে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে জোর আলোচনা।
ক্রিকেট বিশ্লেষকরা কেউ কেউ গিলের ব্যাটিং ধারাবাহিকতা ও নেতৃত্বগুণকে এগিয়ে রাখছেন, আবার কেউ বলছেন স্টোকসের অলরাউন্ড অবদান ও ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অন্য মাত্রার। অন্যদিকে, মুলডারের ব্যাটিং বিস্ফোরণ এবং রেকর্ড গড়া ইনিংস তাকে সেরা করে তোলার জন্য যথেষ্ট বলেই অনেকে মত দিচ্ছেন।
আইসিসি শিগগিরই ভোট ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত বিজয়ীর নাম ঘোষণা করবে। তবে যেই জিতুক না কেন, এই তিনজনই প্রমাণ করেছেন, টেস্ট ক্রিকেট এখনও বেঁচে আছে, এবং ব্যাট-বলের লড়াইয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পেতে হলে ধারাবাহিকতা, নেতৃত্ব ও দৃষ্টিনন্দন পারফরম্যান্স জরুরি।
তিন মনোনীত ক্রিকেটার সংক্ষেপে:
-
শুভমন গিল (ভারত): ৩ টেস্টে ৯৪.৫০ গড়ে ৫৬৭ রান, ৩টি সেঞ্চুরি
-
বেন স্টোকস (ইংল্যান্ড): ৩ টেস্টে ২৫১ রান ও ১২ উইকেট
-
উইয়ান মুলডার (দ. আফ্রিকা): ২ টেস্টে ৫৩১ রান ও ৭ উইকেট, ৩৬৭*-র রেকর্ড ইনিংস
এবারের মাসসেরা প্রতিযোগিতাকে বলা যায় "টেস্ট ক্রিকেটের রাজপুত্রদের লড়াই"—যেখানে গিলের পরিণত ব্যাটিং, স্টোকসের ভয়ডরহীন অলরাউন্ড নেতৃত্ব আর মুলডারের ব্যাটিং বিস্ফোরণ ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে তৈরি করেছে টানটান উত্তেজনা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ