
ছবি: সংগৃহীত
পবিত্র জমজম কূপের পানি শুধু একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন বা পবিত্র হজযাত্রার অংশমাত্র নয়, বরং এটি ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী রহমত, বরকত ও শিফার (রোগমুক্তি) এক অপার উৎস। অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে—রোগমুক্তির উদ্দেশ্যে কি শরীরে জমজমের পানি ছিটানো যাবে? এটা কি শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ?
হাদিসে জমজমের ফজিলত: রোগমুক্তির নিশ্চয়তা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জমজমের পানি সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন:
“خَيْرُ مَاءٍ عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ مَاءُ زَمْزَمَ، فِيهِ طَعَامٌ مِنَ الطّعْمِ وَشِفَاءٌ مِنَ السُّقْمِ”
“পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পানি হচ্ছে জমজমের পানি। এতে রয়েছে খাদ্যের উপাদান এবং রোগ থেকে মুক্তির ক্ষমতা।”
— তাবারানি, হাদিস: ১১১৬৭; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদিস: ৫৭১২
এ হাদিস দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে, জমজমের পানিতে শিফার গুণ রয়েছে। এই পানির মাধ্যমে যে রোগমুক্তি কামনা করে পান করবে, আল্লাহ তাআলা চাইলে তাকে আরোগ্য দেবেন। ফলে, জমজম শরীরে ছিটানো বা ব্যবহার করাও ইসলামী শরিয়তের আলোকে বৈধ ও উত্তম আমল।
রাসুল (সা.) এর আমল এবং সাহাবাদের দৃষ্টান্ত
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জমজমের পানি রোগীদের উপর ছিটাতেন এবং তাদের তা পান করাতেন। তিনিও নিজে রোগমুক্তির জন্য জমজম পান করতেন এবং পড়তেন:
اللّهُمَّ أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا، وَرِزْقًا وَاسِعًا، وَشِفَاءً مِنْ كُلِّ دَاءٍ
“হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে উপকারী জ্ঞান, প্রশস্ত রিযিক এবং সব রোগ থেকে মুক্তি চাই।”
— মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস: ১৭৩৯
ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, “আমি নিজের জীবনে জমজম ব্যবহার করে বহু রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেছি। একবার আমি মক্কায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ি, তখন আমি জমজম পানি নিয়ে তাতে সূরা ফাতিহার অংশ (إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ) পড়ে দম করে পান করি। আল্লাহর কৃপায় আমি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করি।”
— যাদুল মাআদ, ৪/৩৯৩
জমজম পানি খেয়ে জীবন ধারণ: ইতিহাসে বিরল অধ্যায়
জমজম পানির খাদ্যগুণ কতটা কার্যকর, তা বোঝা যায় হযরত আবু যর গিফারি (রা.)-এর অভিজ্ঞতা থেকে। ইসলাম গ্রহণের আগেই তিনি ৩০ দিন শুধু জমজম পান করেই জীবিত ছিলেন। ক্ষুধা অনুভব করেননি, বরং দেহ মোটা হয়ে গিয়েছিল। নবীজী তাকে বলেন:
إِنّهَا مُبَارَكَةٌ، إِنّهَا طَعَامُ طُعْمٍ
“এটা বরকতময় পানি, এতে রয়েছে খাবারের গুণ।”
— সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৪৭৩
সালাফে সালেহীনের দৃষ্টিতে জমজম: একটি মহৌষধ
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের ছেলে বর্ণনা করেন, “আমি আমার বাবাকে দেখেছি তিনি অসুস্থ হলে জমজম পান করতেন এবং সেই পানি দিয়ে মুখ-মাথা মাসাহ করতেন।” — সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১১/২১২
ইমাম তাকীউদ্দীন আলফাসী লিখেছেন, আহমাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আশশারিফী একবার অন্ধত্বে ভোগছিলেন। তিনি জমজম পান করে দোয়াসহ পান করেন এবং আল্লাহর রহমতে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। — শেফাউল গারাম, ১/২৫৫
জমজম কূপে নববী বরকতের ছোঁয়া
জমজম শুধু একটি প্রাকৃতিক কূপ নয়; এটি নবীজী (সা.)-এর বরকতময় স্পর্শে ধন্য। হাদিসে আছে, একবার নবীজী জমজমের পানি পান করেন এবং সেই পানি দিয়ে কুলি করে তা কূপে ঢেলে দেন। এতে জমজমের পানি নববী মুখের বরকত ধারণ করে আরও পবিত্র ও গুণসম্পন্ন হয়ে ওঠে। — মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ৩৫২৭
শরীরে জমজম ছিটানো বিদআত নয়, বরং সুন্নাহসম্মত আমল
উল্লিখিত সমস্ত হাদিস, সাহাবাদের আমল এবং সালাফদের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—রোগমুক্তির জন্য জমজম পানির ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে শরিয়তসম্মত এবং এটি বিদআত নয়। বরং এটি একটি প্রামাণ্য ও ফলদায়ী আমল। আল্লাহ যাদের ওপর রহমত করেন, তারা এ পানির মাধ্যমে রোগমুক্তি লাভ করেন।
আজকের দিনে যখন ওষুধ, চিকিৎসা ও হাসপাতালে নির্ভরতা বাড়ছে, তখন জমজম একটি ইমানী ও রুহানী চিকিৎসার উৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। তবে সবসময় মনে রাখতে হবে—আরোগ্য আসে একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকেই। জমজম কেবল একটি মাধ্যম, দোয়া ও ঈমানই আসল শক্তি।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে জমজমের ফজিলত উপলব্ধি করে তা যথাযথভাবে আমলে নেওয়ার তাওফিক দিন। আমিন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ