
ছবি: সংগৃহীত
পরোপকার—এই একটি শব্দের ভেতরেই নিহিত আছে মানবিকতা, সহমর্মিতা ও সামাজিক শান্তির ভিত্তি। ইসলাম পরোপকারকে শুধু প্রশংসিত কাজ বলেই গণ্য করেনি, বরং এটিকে ঈমানের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। যে মানুষ অন্যের উপকার করে, সে শুধু সমাজের নয়, বরং আল্লাহ তাআলার কাছেও প্রিয় বান্দা। কিন্তু ইসলামে এমন একটি গর্হিত আচরণ আছে, যা এই পরোপকারের সমস্ত সওয়াব ও বরকতকে ধূলিসাৎ করে দেয়—আর সেটি হলো ‘খোঁটা দেওয়া’।
অর্থাৎ কোনো উপকার করার পর সেই উপকারের কথা মানুষকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া, বা তার বিনিময়ে কৃতজ্ঞতা বা মর্যাদা প্রত্যাশা করা ইসলামি দৃষ্টিতে মারাত্মক গুনাহ। কারণ এমন আচরণ আল্লাহর পথে করা সদকার আসল উদ্দেশ্য—‘ইখলাস’ বা একনিষ্ঠতা—কে বিনষ্ট করে দেয়।
ইসলামের মূল শিক্ষা হচ্ছে মানবসেবা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের বেশি উপকার করে, সেই মানুষই শ্রেষ্ঠ। (আল মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৫৭৮৭)
মানুষের উপকার করার পথও বহুমাত্রিক। কেউ অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে পারেন, কেউ শারীরিক শক্তি দিয়ে, কেউ জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়ে, আবার কেউ তার সময় ও পরামর্শ দিয়ে সমাজের উন্নতি ঘটাতে পারেন। ইসলাম প্রত্যেকেরই এই ভিন্ন ভিন্ন যোগ্যতাকে সৃষ্টির সেবায় নিয়োজিত করার নির্দেশ দিয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন— “আমরা তো তোমাদের খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। আমরা তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও না।” (সুরা দাহর, আয়াত : ৯)
অর্থাৎ, সত্যিকার পরোপকার তখনই গ্রহণযোগ্য হয়, যখন তার উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
কোরআনে খোঁটা দেওয়াকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন— “হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের দান-সদকা খোঁটা ও কষ্ট দিয়ে বিনষ্ট কোরো না, সেই ব্যক্তির মতো, যে নিজ ধনসম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য, অথচ সে আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী নয়।”
(সুরা বাকারা, আয়াত : ২৬৪)
এই আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি তার দান-খয়রাতের পর মানুষকে অপমান করে, খোঁটা দেয় বা নিজের অনুগ্রহকে বড় করে তুলে ধরে, তার সেই দান আল্লাহর কাছে অকেজো হয়ে যায়। কোরআন সেই ব্যক্তিকে তুলনা করেছেন এমন এক মসৃণ পাথরের সঙ্গে, যার ওপর অল্প কিছু মাটি আছে। ভারি বৃষ্টিতে সেই মাটি সরে গেলে পাথর যেমন শুষ্ক হয়ে যায়, তেমনি ওই ব্যক্তির দানও সওয়াবহীন হয়ে পড়ে।
খোঁটা দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে মহানবী (সা.) একাধিকবার সতর্ক করেছেন। আবু জার (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন— “তিন ব্যক্তির সঙ্গে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা কথা বলবেন না, তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না, বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।”
আবু জার (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, তারা কারা? নবী (সা.) উত্তরে বললেন—
১. যে ব্যক্তি অহংকারে কাপড় টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে রাখে,
২. যে ব্যক্তি উপকার করে পরে খোঁটা দেয়,
৩. যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করে।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১০৬)
এই হাদিস থেকে স্পষ্ট হয়—খোঁটা দেওয়া শুধু নৈতিক ত্রুটি নয়, বরং এটি এমন এক অপরাধ যা আল্লাহর রহমত থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে দেয়।
ইসলাম পরোপকারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ‘ইখলাস’ বা একনিষ্ঠতাকে। যে দান কেবল লোকদেখানোর জন্য করা হয়, সেটি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
মহান আল্লাহ বলেন— “যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধনসম্পদ ব্যয় করে, অতঃপর খোঁটা দেয় না বা কষ্ট দেয় না, তাদের জন্য তাদের রবের কাছে আছে পুরস্কার। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।”
(সুরা বাকারা, আয়াত : ২৬২)
এই আয়াত শুধু নিষেধই করছে না, বরং ইঙ্গিত দিচ্ছে—যে ব্যক্তি নিঃস্বার্থভাবে দান করে, আল্লাহ তাআলা নিজ হাতে তার পুরস্কার নিশ্চিত করবেন। এমন ব্যক্তির জন্য থাকবে নির্ভয় ও প্রশান্ত জীবন।
খোঁটা দেওয়া শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিতে নয়, সামাজিক দৃষ্টিতেও মারাত্মক ক্ষতিকর। উপকারের পর বারবার স্মরণ করিয়ে দিলে উপকারভোগীর মধ্যে লজ্জা, অপমান ও আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগে। এতে সম্পর্কের বন্ধন দুর্বল হয়, পারস্পরিক বিশ্বাস নষ্ট হয়।
যেখানে পরোপকারের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সমাজে ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি করা, সেখানে খোঁটা দেওয়ার মাধ্যমে সেটি পরিণত হয় ঘৃণা ও অবিশ্বাসে। ফলে উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি হয় সমাজের সামগ্রিক বন্ধনে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন— “আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে।” (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৪৬; তিরমিজি, হাদিস : ১৪২৫)
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে অন্যের উপকার করে, আল্লাহ তাআলা নিজে তার রক্ষক ও সহায়ক হয়ে যান। এমন দান-সেবা শুধু দুনিয়ায় শান্তি দেয় না, বরং আখেরাতেও অগণিত পুরস্কার এনে দেয়।
ইসলাম দান ও পরোপকারকে ঈমানের অপরিহার্য অংশ হিসেবে দেখেছে। কিন্তু সেই দান তখনই মূল্যবান, যখন তা করা হয় নিঃস্বার্থভাবে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। খোঁটা, অহংকার বা প্রতিদানপ্রত্যাশা সেই দানের সৌন্দর্যকে ম্লান করে দেয়।
অতএব, মুসলমান হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলো—যদি কোনো উপকার করি, তা ভুলে যাওয়া, আর যদি কেউ উপকার করে, তা চিরদিন স্মরণে রাখা।
কারণ, খোঁটা দিলে উপকারের সওয়াব বিনষ্ট হয়, কিন্তু নিঃস্বার্থ দানে থাকে আল্লাহর রহমত, বরকত ও আখেরাতের চিরস্থায়ী পুরস্কার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ