
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বাস্তবায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিভাগের দায়িত্বে থাকা সদস্য মোহাম্মদ বেলাল হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদ গোপনের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের উপপরিচালক মো. সাইদুজ্জামান বাদী হয়ে ২০২৫ সালের ৭ অক্টোবর (মঙ্গলবার) ঢাকায় দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
দুদকের মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, বেলাল হোসেন চৌধুরী সরকারি দায়িত্ব পালনের সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন, যার উল্লেখ তার দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ছিল না। ২০২২ সালের জুলাই মাসে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে তিনি মোট ৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য দেন। তবে দুদকের অনুসন্ধানে তার নামে ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে মোট ১৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকার সম্পদ পাওয়া গেছে, যা তার ঘোষিত সম্পদের তুলনায় প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা বেশি।
এছাড়াও, মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, দায়-দেনা হিসাব করলে তার প্রকৃত নীট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অথচ বৈধভাবে তিনি আয় করেছেন প্রায় ১১ কোটি ৫২ লাখ টাকা। কিন্তু তার প্রকৃত সম্পদ বৈধ আয়ের তুলনায় ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা বেশি। অর্থাৎ, তিনি প্রকৃত আয়ের বাইরে প্রায় ৫ কোটি টাকার সম্পদ গোপন করেছেন এবং অবৈধভাবে অর্জন করেছেন বলে দুদক প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, বেলাল হোসেন চৌধুরী রাজধানী ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন স্থানে জমি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ উচ্চমূল্যের স্থাবর সম্পদ ক্রয় করেছেন। শুধু তাই নয়, তার নামে এবং তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের নামে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার, ডেভেলপার ও রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করার তথ্যও পাওয়া গেছে।
এ সকল কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪-এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারায় মামলা দায়েরের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের অভ্যন্তরে প্রভাব বিস্তার, উচ্চপদস্থদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও প্রশাসনিক সুবিধা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে বেলাল হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন ধরেই তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও, এবার দুদক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে সরাসরি মামলা করল।
অবৈধ সম্পদ সংক্রান্ত অভিযোগ ছাড়াও বেলাল হোসেন চৌধুরীর বিদেশ সফর নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার একটি আদালত তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিনি ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে অস্ট্রেলিয়ার সিডনির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।
এদিকে, সরকারি অনুমোদন অনুযায়ী তার গন্তব্য ছিল ইন্দোনেশিয়ার একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা অবস্থায় বিদেশে যাওয়ার ঘটনায় দায়িত্বশীল মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
তবে এ বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে বেলাল হোসেন চৌধুরী দাবি করেছেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে পরবর্তীতে তাকে দুই মাসের বিদেশযাত্রার অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি সরকারের জিও অনুযায়ী ১৯–২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ইন্দোনেশিয়ায় প্রশিক্ষণে অংশ নেন এবং ট্রানজিট হিসেবে সিডনিতে ১৭ ঘণ্টা অবস্থান করেন। এ সময় তিনি দেশে ফিরেই আদালতকে বিষয়টি অবহিত করেছেন বলেও জানিয়েছেন। তবে কারণ দর্শানোর জবাবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন করতে বিলম্ব হওয়ায় আরও ১০ কার্যদিবস সময় চেয়েছেন তিনি।
দুদকের উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, এনবিআরের এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সাল থেকেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। বিশেষ করে তার নামে–বেনামে সম্পদের পরিমাণ বাড়তে থাকায় এবং বিদেশে সম্পদ সঞ্চয়ের অভিযোগ উঠায় তদন্ত জোরদার করা হয়।
দুদকের তথ্যমতে, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে বেলাল চৌধুরীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এছাড়াও তার ভাইসহ বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে দেশীয় শেয়ারবাজারে, রিয়েল এস্টেট খাতে ও বিভিন্ন প্রজেক্টে বিনিয়োগের প্রমাণ মিলেছে।
সব মিলিয়ে, এ মামলাকে বর্তমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এখন দেখার বিষয়—দুদক কতটা দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত চালিয়ে এই মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করতে পারে।
সরকারি উচ্চপদে থেকে দেশের অন্যতম রাজস্ব কর্তৃপক্ষ এনবিআরে দায়িত্ব পালনের সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে, এটি হবে প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থার জন্য একটি বড় আঘাত। তবে দুদকের পদক্ষেপ দেশবাসীর কাছে একটি ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে—কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
বাংলাবার্তা/এসজে