
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অর্থনীতি এখন এক গভীর অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে। উৎপাদন, রপ্তানি, নতুন বিনিয়োগ—সব ক্ষেত্রেই এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই মুহূর্তে তারা শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গেও লড়ছেন। ডলারসংকট, গ্যাস-বিদ্যুৎ ঘাটতি, ব্যাংক সুদহারের লাগামহীন বৃদ্ধি এবং শ্রম আইনের সংস্কার নিয়ে অস্পষ্টতা—সব মিলিয়ে বিনিয়োগ পরিবেশে ছায়া ফেলেছে ভয়াবহ অস্থিরতা। নতুন বিনিয়োগে কেউ ঝুঁকি নিতে চাইছেন না, বরং পুরোনো বিনিয়োগও এখন পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে।
অর্থনীতির চালিকাশক্তি বেসরকারি খাতের শীর্ষ উদ্যোক্তাদের ভাষায়, “দেশে এখন ব্যবসা চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।” অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে, আবার কেউ কেউ সাময়িকভাবে কারখানা বন্ধ রাখছেন। এতে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। রপ্তানিমুখী শিল্প, বিশেষত তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার খাতেও দেখা দিয়েছে অর্ডার কমে যাওয়ার প্রবণতা।
মূলধনি যন্ত্রপাতি বা কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাংকে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলা এখন সবচেয়ে বড় দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। ডলারসংকটের কারণে অনেক ব্যাংক এলসি খুলতে চাইছে না, আবার কেউ কেউ শর্ত দিয়েছে ১০০ শতাংশ মার্জিন জমা রাখতে হবে—যা বেশিরভাগ উদ্যোক্তার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা থামিয়ে রেখেছে। নতুন কারখানা স্থাপনের প্রস্তুতিও স্থগিত রয়েছে।
সম্প্রতি ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহার বেড়ে ১৬ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, এই হারে ঋণ নিয়ে কোনো প্রকল্প চালানো বা নতুন ব্যবসা শুরু করা কার্যত অসম্ভব। আগে যেখানে ৯ থেকে ১০ শতাংশ সুদে ব্যবসা চলতো, এখন সেখানে সুদে-আসলে সব মুনাফা খেয়ে নিচ্ছে ব্যাংক। অনেকেই বাধ্য হয়ে প্রকল্প স্থগিত করেছেন বা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের এক পরিচালক বলেন, “একদিকে কাঁচামালের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যাংক সুদহার আকাশচুম্বী—এই অবস্থায় শিল্প টিকবে কীভাবে? সরকারকে দ্রুত সুদহার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, নইলে উদ্যোক্তারা একে একে বাজার থেকে হারিয়ে যাবেন।”
অর্থনীতির পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক পরিবেশও এখন বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও স্থিতিশীলতা এখনো ফেরেনি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, যতদিন রাজনৈতিক আস্থা ফিরে না আসে, ততদিন বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগকারী কেউই ঝুঁকি নেবে না।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, “সবমিলিয়ে আসলে জগাখিচুড়ি অবস্থা তৈরি হয়েছে। সমাজের কেউই এখন কারও ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। ব্যাংকের সুদহার বেশি, গ্যাসের সংকট কিছুটা কমলেও সেটা আবার বাড়তে পারে। সবমিলিয়ে পরিবেশ বিনিয়োগবান্ধব নয়। গত এক বছরের পরিসংখ্যানই সেটা বলছে।”
তিনি আরও বলেন, “বিদেশি বা দেশি কোনো নতুন বিনিয়োগ এখন হচ্ছে না। যেগুলো হচ্ছে, সেগুলো আগের অসম্পূর্ণ বিনিয়োগ—এখন শুধু সম্পূর্ণ করা হচ্ছে। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সরকার, প্রশাসন, ব্যবসায়ী—সব পক্ষকে একসঙ্গে বসে কাজ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকেও এ বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে।”
বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে দেখা গেছে, কারখানাগুলো আগের মতো পূর্ণ সক্ষমতায় চলছে না। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান দিনে অল্প সময় উৎপাদন চালাতে পারছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের শ্রমিক সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে, কারণ অর্ডার কমে যাওয়ায় উৎপাদনের প্রয়োজনও কমে গেছে। এতে বিপাকে পড়েছে নিম্নআয়ের লাখো শ্রমজীবী মানুষ।
একটি নিটওয়্যার কারখানার মালিক বলেন, “আগে আমরা দিনে তিন শিফটে কাজ করতাম, এখন এক শিফটেই কাজ শেষ হচ্ছে। অনেক শ্রমিককে ছুটি দিতে হচ্ছে, কারণ অর্ডারই নেই।”
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “ব্যবসা-বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো আস্থা। এখনকার পরিস্থিতিতে সেটাই অনুপস্থিত। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা যত দীর্ঘ হবে, অর্থনীতির পুনরুদ্ধার তত বিলম্বিত হবে। সবকিছু থমকে আছে, এবং এই স্থবিরতা নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত কাটবে না।”
তিনি বলেন, “বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চান। রাজনৈতিক ঝুঁকি থাকলে তারা বিনিয়োগে আগ্রহ হারান। এর প্রভাব শুধু বিনিয়োগে নয়, রপ্তানি, রাজস্ব, এমনকি কর্মসংস্থানেও পড়বে। অর্থনীতির সব সূচকই এখন নিম্নমুখী।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো আস্থা ফিরিয়ে আনা। তার জন্য সরকারকে ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে, গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে হবে, শ্রম আইন সংস্কার স্পষ্ট করতে হবে এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতি প্রণয়ন করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
এক অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেন, “যদি এই স্থবিরতা আরও কয়েক মাস থাকে, তবে দেশ দীর্ঘমেয়াদি মন্দার দিকে যাবে। এ অবস্থায় সরকার ও ব্যবসায়ী উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থা ও সংলাপ প্রয়োজন। অর্থনীতি কোনো দলীয় বিষয় নয়—এটি জাতির ভবিষ্যৎ।”
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে সংকটে জর্জরিত শিল্পখাত, অন্যদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা—দুটিই মিলে অর্থনীতিকে টেনে নিচ্ছে স্থবিরতার গভীরে। উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকার যদি দ্রুত স্থিতিশীলতা ফেরাতে পারে এবং আস্থা পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়, তবে অর্থনীতি আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু যদি এই অনিশ্চয়তা আরও দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে বাণিজ্যের এই স্থবিরতা এক ভয়াবহ মন্দার রূপ নিতে পারে—যার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ