
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোয় বড় ধরনের সংস্কার আসছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদের নামসহ প্রশাসনের শীর্ষ কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংস্কার কমিশনের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নে গত জুলাই মাসেই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা পাঠানো হয়। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।
এই সংস্কার কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হলো প্রশাসনকে আরও আধুনিক, জবাবদিহিমূলক, মেধাভিত্তিক ও দক্ষ কাঠামোয় রূপ দেওয়া। বিশেষ করে মাঠপর্যায়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক নেতৃত্বের কাঠামো পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে ‘একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী প্রশাসন’ গড়ে তোলা।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, জেলা প্রশাসকের নতুন নাম হবে ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কমিশনার’, আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নাম পরিবর্তিত হয়ে হবে ‘উপজেলা কমিশনার’।
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসসংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার) এ বিষয়ে ইতোমধ্যে নির্দেশনা পেয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই বাস্তবায়ন হবে।”
এ পরিবর্তনের ফলে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কার্যপরিধি ও পদমর্যাদা নতুন কাঠামো অনুযায়ী পুনর্বিন্যাস করা হবে। এতে মাঠ প্রশাসনের ভূমিকা আরও শক্তিশালী হবে এবং কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণের সঙ্গে তাদের সমন্বয়ও বৃদ্ধি পাবে।
সবচেয়ে বড় সংস্কারটি হতে যাচ্ছে “সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস” (SES) নামের নতুন কাঠামো গঠনের মাধ্যমে।
এই কাঠামোর অধীনে উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলো পুনর্গঠিত হবে। এখন পর্যন্ত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা এই পদগুলোর বড় অংশ দখল করে রাখলেও নতুন কাঠামো কার্যকর হলে সব ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সমান সুযোগ পাবেন।
সংস্কার কমিশনের মতে, এসইএস গঠনের মাধ্যমে ‘মেধা ও দক্ষতা নির্ভর প্রশাসনিক নেতৃত্ব’ নিশ্চিত করা হবে। এটি আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিনের আন্তঃক্যাডার বৈষম্য ও অসন্তোষ দূর করবে।
প্রস্তাব অনুযায়ী—
-
সব সার্ভিসের অন্তত ১০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তারা এসইএসে অংশ নিতে পারবেন।
-
পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) প্রতিবছর উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের জন্য আলাদা পরীক্ষা নেবে।
-
প্রতিযোগিতায় যারা উত্তীর্ণ হবেন, তারা সরাসরি এসইএসের আওতায় চলে আসবেন।
-
কোনো কর্মকর্তা টানা দুইবার পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে তিনি আর এসইএসে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাবেন না।
-
এসইএসে প্রবেশের পর কর্মকর্তার জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হবে মেধাক্রম অনুযায়ী, যা সার্বিক পদোন্নতিতে প্রতিফলিত হবে।
এসইএসে যোগ দেওয়ার পর আর কেউ তার মূল ক্যাডারে ফিরে যেতে পারবেন না। অর্থাৎ একজন কর্মকর্তা যদি কর ক্যাডার থেকে এসে এসইএসে যোগ দেন, তাহলে তিনি আর তার আগের সার্ভিসে ফিরে যেতে পারবেন না।
যেসব কর্মকর্তা বর্তমানে উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ে কর্মরত আছেন, তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসইএসের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। সচিব, মুখ্য সচিব এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদেও এ অন্তর্ভুক্তি কার্যকর হবে।
এছাড়া, অতিরিক্ত সচিবদের মধ্য থেকে সচিব এবং সচিবদের মধ্য থেকে মুখ্য সচিব পদে পদোন্নতির জন্য মন্ত্রিসভা কমিটি বাছাই করবে এবং সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠাবে।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের কাঠামো নতুনভাবে সাজানো হবে।
-
উপজেলা কমিশনার, জেলা কমিশনার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার এবং বিভাগীয় কমিশনার পদগুলোতে মূলত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরই পদায়ন হবে।
-
তবে জেলা কমিশনারের পদটি এসইএসের আওতায় থাকবে, যদিও সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই নিয়োগ পাবেন।
-
‘অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)’ পদের নামও পরিবর্তন করে রাখা হচ্ছে ‘অতিরিক্ত জেলা কমিশনার (ভূমি ব্যবস্থাপনা)’।
নতুন কাঠামোর মাধ্যমে মাঠ প্রশাসনে কর্তৃত্ব, দায়িত্ব ও জবাবদিহি স্পষ্টভাবে ভাগ করা হবে। স্থানীয় জনগণের সেবা প্রদানে দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রশাসনকে আরও জনবান্ধব করে তোলা হবে।
এই পদ পরিবর্তনের বাইরেও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রায় ২০০টির বেশি কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—
-
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ডিজিটাল সার্ভিস উইন্ডো স্থাপন
-
সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহিমূলক পারফরম্যান্স ইভ্যালুয়েশন ব্যবস্থা
-
শিক্ষার্থী ও নাগরিকবান্ধব সেবা কাঠামো
-
স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সরকারি দপ্তরের সমন্বয় জোরদার
-
প্রান্তিক পর্যায়ে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও সেবার ডিজিটালাইজেশন
কমিশনের মতে, এসব পরিবর্তন বাস্তবায়িত হলে প্রশাসনের কার্যকারিতা ও সেবাদানের মান বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
বর্তমানে উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলো সরকারের ‘সুপিরিয়র পোস্ট’ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ পর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫% এবং অন্যান্য ক্যাডারের ২৫% কর্মকর্তা পদোন্নতি পান।
তবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে এই কোটা ব্যবস্থা তুলে দিয়ে শতভাগ পদোন্নতির দাবি জানিয়ে আসছেন। অপরদিকে, অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা পরীক্ষার মাধ্যমে সমান সুযোগের দাবি জানাচ্ছেন।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে এই দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, এসইএস কাঠামোয় ক্যাডারভিত্তিক কোটার পরিবর্তে “যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি” হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই পরিবর্তন বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ প্রশাসনের ইতিহাসে এটি হবে এক যুগান্তকারী রূপান্তর। ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা “ডেপুটি কমিশনার” ও “উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা” পদবি ইতিহাসে স্থান করে নেবে, তার জায়গায় আসবে “কমিশনার” ভিত্তিক আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামো।
একজন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “এটি শুধুই পদ পরিবর্তন নয়; এটি পুরো প্রশাসনের দর্শন বদলে দেওয়ার উদ্যোগ। এখন থেকে নেতৃত্ব নির্ধারিত হবে মেধা ও সক্ষমতার ভিত্তিতে, পদমর্যাদার নয়।”
সব মিলিয়ে, প্রশাসনের এই সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন থেকে শুরু করে নীতি নির্ধারণী স্তর পর্যন্ত এক নতুন গতিশীলতা আসবে। ডিসি-ইউএনও পদের নাম বদল শুধুই প্রতীক নয়—এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কারের নতুন অধ্যায়ের সূচনাও হতে যাচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ