
ছবি: সংগৃহীত
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সামান্য পরিবর্তন এসেছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্ধারিত হিসাব পদ্ধতি—ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল সিক্সথ এডিশন (BPM6)—অনুসারে প্রকৃত বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা কম, দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
রোববার (৫ অক্টোবর) বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিবৃতিতে এই তথ্য প্রকাশ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা স্থিতি দেখা গেলেও, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, আমদানি বিল নিষ্পত্তি এবং বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে সরবরাহ বজায় রাখার কারণে রিজার্ভের ওপর চাপ অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান গণমাধ্যমকে বলেন, “আমাদের হিসাব অনুযায়ী, দেশের রিজার্ভ এখন ৩১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে আইএমএফের BPM6 পদ্ধতি অনুযায়ী, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়, সেই হিসেবে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।”
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, “এই পার্থক্যের মূল কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে কিছু তহবিল যেমন এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (EDF), গ্রীন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড এবং বিশেষ আমদানি সহায়তা তহবিলকে রিজার্ভের আওতায় ধরা হয়। কিন্তু আইএমএফের BPM6 মানদণ্ডে এগুলোকে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের অংশ হিসেবে ধরা হয় না, কারণ এগুলো সরাসরি বৈদেশিক লেনদেনে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারযোগ্য নয়।”
আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো হতে হয়। অর্থাৎ, কোনো দেশ যদি বৈদেশিক আয়ের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় এমন অবস্থায়ও তিন মাস আমদানি চালিয়ে যেতে পারে, সেটিই নিরাপদ সীমা হিসেবে বিবেচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে দেশের মাসিক গড় আমদানি ব্যয় প্রায় ৮ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসেবে বর্তমান রিজার্ভে বাংলাদেশ এখন প্রায় তিন মাসের মতো আমদানি ব্যয় নির্বাহ করতে সক্ষম। তবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ২৬.৬২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসায় পরিস্থিতি নিরাপদ সীমার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে বলে স্বীকার করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি, গ্যাস, খাদ্যপণ্য ও কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি না থাকায় রিজার্ভে চাপ বাড়ে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক পদক্ষেপ নেয়—
-
অপ্রয়োজনীয় আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ,
-
এলসি (L/C) খোলায় সীমাবদ্ধতা,
-
বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সময়সূচিতে পুনর্বিন্যাস,
-
এবং বাজারভিত্তিক বিনিময় হার (ফ্লেক্সিবল এক্সচেঞ্জ রেট) চালুর মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
তবুও রিজার্ভে প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। গত দুই বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করেছে বাজারে, যাতে ডলার ঘাটতি সামাল দেওয়া যায় এবং আমদানি পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা যায়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে BPM6 পদ্ধতিতে রিজার্ভ গণনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই শর্ত অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন নাগাদ ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ অন্তত ২৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ লক্ষ্য অর্জন সহজ হবে না। কারণ, একদিকে রপ্তানি আয় বৃদ্ধির হার মন্থর, অন্যদিকে প্রবাসী আয়ের বেশির ভাগ অংশ আসছে অনানুষ্ঠানিক পথে (হুন্ডি)। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার প্রবাহ সীমিত হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ (বিশ্বব্যাংক, ঢাকা অফিস), বলেন, “রিজার্ভ পুনরুদ্ধারের জন্য শুধু আমদানি নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট নয়। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে বাজারভিত্তিক একটি কাঠামো তৈরি করা, যাতে আস্থা ফিরে আসে।”
বর্তমানে আন্তঃব্যাংক ডলার বিনিময় হার ১১৮ থেকে ১১৯ টাকার মধ্যে থাকলেও, খোলা বাজারে রেট কিছুটা বেশি—প্রতি ডলার ১২২ থেকে ১২৩ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ব্যবধানই হুন্ডি লেনদেনকে উৎসাহিত করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বাজারভিত্তিক রেট বাস্তবায়নের কাজ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে, তবে এ নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনাও চলছে। একই সঙ্গে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন রিজার্ভ থেকে অপ্রয়োজনীয় খরচে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে এবং সরকারি প্রকল্পের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ও সীমিত করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, রিজার্ভের এই অবস্থান দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সতর্ক সংকেত। তাঁরা মনে করেন, যদি প্রবাসী আয়ের আনুষ্ঠানিক প্রবাহ না বাড়ে এবং রপ্তানি খাত প্রত্যাশিত গতি না পায়, তবে রিজার্ভ আরও কমে যেতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “রিজার্ভের এই স্তর মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। এখন সরকারকে ডলার আয় বৃদ্ধিমুখী খাতগুলোতে প্রণোদনা দিতে হবে, বিশেষ করে রেমিট্যান্সে আনুষ্ঠানিক পথে লেনদেন নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় ২০২৫ সালের মধ্যে আইএমএফের নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণ করা কঠিন হবে।”
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সামান্য স্থিতিশীলতা দেখা গেলেও, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রকৃত চিত্র এখনো উদ্বেগজনক। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ২৬.৬২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসা মানে হলো, দেশের অর্থনীতি এখন ন্যূনতম নিরাপত্তা সীমারেখায় অবস্থান করছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রিজার্ভ বাড়াতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে—রপ্তানি খাতকে পুনরুজ্জীবিত করা, হুন্ডি প্রতিরোধে নজরদারি বাড়ানো এবং রাজনৈতিক ও নীতিগত স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা ছাড়া বিকল্প নেই।
একজন সিনিয়র ব্যাংকারের ভাষায়, “রিজার্ভ শুধু সংখ্যার বিষয় নয়, এটি দেশের আস্থার প্রতীক। এই আস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ