
ছবি: সংগৃহীত
দেশব্যাপী কর ফাঁকি রোধ ও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ের গোয়েন্দা তৎপরতা আরও জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি বছরের ৫ অক্টোবর রবিবার জারি করা এক নির্দেশনায় প্রতিটি কর অঞ্চলের ‘ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন সেল (আইআইসি)’–এর কার্যক্রম সক্রিয় ও শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আল-আমিন শেখ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, কর ফাঁকি প্রতিরোধ এবং ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব পুনরুদ্ধারকে আরও গতিশীল করতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের কর প্রশাসনের কাঠামোয় কর ফাঁকি শনাক্ত ও তদন্তে তিনটি প্রধান ইউনিট কাজ করে—কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (CIC), আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট (DITU), এবং প্রতিটি কর অঞ্চলে গঠিত ‘ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন সেল (IIC)’। এর মধ্যে মাঠপর্যায়ের কর অঞ্চলগুলোয় গঠিত আইআইসি ইউনিটগুলোকে এবার আরও কার্যকর, সমন্বিত ও ফলপ্রসূভাবে পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে এনবিআর।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে শুধু নতুন করদাতা শনাক্ত করাই নয়, বরং পুরোনো করদাতাদের জমাকৃত আয়কর রিটার্ন ও সম্পদ বিবরণীর সঙ্গতিপূর্ণতা যাচাই করাও আইআইসির অন্যতম দায়িত্ব।
এনবিআর সদস্য (কর অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন) মোহাম্মদ মোস্তফা স্বাক্ষরিত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রতিটি কর অঞ্চল নিজস্বভাবে একটি বা একাধিক ‘ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন সেল (IIC)’ টিম গঠন করবে। এই টিমগুলোর কাজের ধরন, সুপারিশ প্রণয়নের ধাপ, তদন্তের পদ্ধতি এবং ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া সম্পর্কেও বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
প্রতিটি টিমকে নির্দিষ্ট প্রমাণ, সন্দেহজনক আয়কর নথি, করদাতার অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধি, মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য বা নাগরিক অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করতে হবে। তদন্ত পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে কর ফাঁকির ইঙ্গিত পাওয়া গেলে সেই তথ্য আইআইসি কমিটির অনুমোদনের জন্য লিখিতভাবে দাখিল করতে হবে।
যদি তদন্তে কর ফাঁকির সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়, তবে সংশ্লিষ্ট কর কমিশনারেটের আইআইসি কমিটি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজস্ব পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
নির্দেশনায় বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে, তদন্ত কার্যক্রম শুরু করার আগে বিভিন্ন উৎস থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে—
-
কর ফাঁকির বিষয়ে প্রাপ্ত অভিযোগ,
-
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন,
-
কর ফাইল, রেজিস্টার বা রিটার্নে ঘষা-মাজা, কাটাকুটি বা অসঙ্গতি,
-
করযোগ্য আয় ও পরিশোধিত করের সঙ্গে সম্পদ বিবরণীর অমিল,
-
অস্বাভাবিক পরিমাণ করমুক্ত আয় প্রদর্শন ইত্যাদি।
এমন ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট টিম স্বাধীনভাবে মাঠতদন্ত পরিচালনা করবে এবং প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব, স্থাবর সম্পদ, ব্যবসার নথি ও আর্থিক লেনদেনের রেকর্ড পর্যালোচনা করতে পারবে।
তদন্ত শেষে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত যদি রাজস্ব ফাঁকির স্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে গণ্য হয়, তাহলে টিমটি সংশ্লিষ্ট কর কমিশনারেটের ‘ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন সেল (আইআইসি)’ কমিটির কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপর কমিটি তা যাচাই-বাছাই করে আইনি প্রক্রিয়ায় রাজস্ব পুনরুদ্ধারের অনুমোদন দেবে।
এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কর ফাঁকির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জরিমানা, অতিরিক্ত কর আরোপ, এমনকি মামলা দায়ের পর্যন্ত পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
প্রতিটি কর কমিশনারেটকে প্রতি মাসে আইআইসি কার্যক্রমের অগ্রগতি প্রতিবেদন এনবিআরে পাঠাতে হবে। নির্ধারিত ছকে প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে বিস্তারিত তথ্য পাঠাতে হবে, যাতে থাকবে—
-
আইআইসি টিমের তদন্ত সংখ্যা,
-
অতিরিক্ত কর দাবি,
-
পুনরুদ্ধারকৃত রাজস্বের পরিমাণ,
-
অসম্পূর্ণ তদন্তের অগ্রগতি।
এই নিয়মিত প্রতিবেদন ব্যবস্থা মাঠপর্যায়ের গোয়েন্দা কার্যক্রমের জবাবদিহি ও তদারকি নিশ্চিত করবে বলে এনবিআর মনে করছে।
এনবিআর মনে করছে, আইআইসি ইউনিটগুলোর কার্যক্রম শক্তিশালী করার মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি শনাক্ত ও পুনরুদ্ধারের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এতে একদিকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে, অন্যদিকে কর ফাঁকির প্রবণতা কমবে এবং সুশৃঙ্খল কর সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।
নির্দেশনায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, গোয়েন্দা কার্যক্রমকে আরও তথ্যনির্ভর করতে হলে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে কর তথ্য বিশ্লেষণ, সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন চিহ্নিতকরণ ও অডিট কার্যক্রম আরও আধুনিক ও দ্রুততর করা সম্ভব হবে।
অর্থনীতি ও রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এনবিআরের এই উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে কর ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আরিফ হোসেন বলেন, “আইআইসি ইউনিটগুলোকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারলে অনেক অঘোষিত আয় ও সম্পদের সন্ধান পাওয়া যাবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে এবং সৎ করদাতারা উৎসাহিত হবেন।”
ট্যাক্স কনসালট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ খালেক বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে অনেক কর অঞ্চলেই আইআইসি ইউনিটগুলো কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ ছিল। এবার যদি কেন্দ্রীয়ভাবে এই ইউনিটগুলোর ওপর কঠোর নজরদারি হয়, তবে কর ফাঁকিবাজদের আর সহজে পার পাওয়া সম্ভব হবে না।”
এনবিআর আশাবাদী, কর ফাঁকি রোধে শক্তিশালী গোয়েন্দা কার্যক্রম গড়ে উঠলে দেশের সামগ্রিক কর সংস্কৃতি নতুন মাত্রা পাবে। এতে সাধারণ করদাতাদের মধ্যে কর পরিশোধে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি পাবে, যা সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ের স্থায়ী উৎস হিসেবে রাজস্ব খাতকে আরও শক্তিশালী করবে।
এনবিআর সূত্র জানায়, ভবিষ্যতে কর প্রশাসনে ডিজিটাল গোয়েন্দা প্ল্যাটফর্ম চালু করার পরিকল্পনাও রয়েছে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে সন্দেহজনক লেনদেন ও সম্পদ পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হবে।
সব মিলিয়ে এনবিআরের এই পদক্ষেপকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় এক যুগান্তকারী উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে—যা শুধুমাত্র কর ফাঁকি প্রতিরোধই নয়, বরং দেশের কর সংস্কৃতিকে আরও আধুনিক, জবাবদিহিমূলক এবং তথ্যনির্ভর কাঠামোয় রূপান্তরের পথ উন্মুক্ত করবে।
বাংলাবার্তা/এসজে