
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের সিকিম, দার্জিলিং এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় টানা ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ হঠাৎ করে ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজের আশপাশের নিম্নাঞ্চলজুড়ে দেখা দিয়েছে বন্যার আশঙ্কা। স্থানীয় প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং ইউনিয়ন পরিষদগুলো ইতিমধ্যে মাইকিং করে মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে পাউবোর সর্বশেষ পরিমাপ অনুযায়ী, তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানির উচ্চতা রেকর্ড করা হয়েছে ৫২ দশমিক ৩৫ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপরে। পানির অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে ব্যারাজ এলাকার ৪৪টি গেট সম্পূর্ণ খুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে পানি দ্রুত প্রবাহিত হতে পারে। তবুও আশঙ্কা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত স্রোতের কারণে ব্যারাজের পাশে অবস্থিত ফ্লাটবাইপাস সড়ক ভেঙে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের রংপুর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার জানিয়েছেন, “উজানে ভারি বর্ষণের কারণে পানির প্রবাহ ক্রমেই বাড়ছে। আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। ব্যারাজের গেটগুলো খুলে দিয়ে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। সব ধরনের জরুরি প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে, তবে পানি আরও বাড়লে নিম্নাঞ্চলে বড় ধরনের প্লাবন ঘটতে পারে।”
গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানির উচ্চতা বেড়েছে প্রায় ৮২ সেন্টিমিটার। এতে তিস্তা তীরবর্তী লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার বহু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। নদীর পানি তীব্র স্রোতে বয়ে যাওয়ায় তীরবর্তী বাঁধগুলোর উপর চাপ বাড়ছে। কয়েকটি স্থানে ইতোমধ্যে ছোটখাটো ভাঙন দেখা দিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার জানিয়েছেন, “আমরা পাঁচটি উপজেলার নির্বাহী অফিসারদের সতর্ক করেছি। তারা মাঠপর্যায়ে মনিটরিং করছেন এবং যেসব এলাকায় পানি প্রবেশ করছে, সেখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে।” তিনি আরও বলেন, “যদি পানি আরও বাড়ে, তবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হবে এবং ত্রাণ বিতরণ শুরু হবে।”
নদীর তীরবর্তী এলাকা—পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও লালমনিরহাট সদর উপজেলার বহু গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই গবাদি পশু ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উঁচু জায়গায় বা স্কুল-মাদ্রাসায় আশ্রয় নিচ্ছেন। প্রশাসনের মাইকিংয়ের পাশাপাশি মসজিদ থেকেও স্থানীয়রা জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা তিস্তা নদীর তীরে বসবাসরত কৃষক আব্দুল জলিল বলেন, “বিকেলের দিকেও পানি ছিল হাঁটু সমান, এখন কোমর ছুঁই ছুঁই। নদীর ধারে বসবাস করছি বলে প্রতি বছরই আতঙ্কে থাকতে হয়। এবার পানি যেভাবে বাড়ছে, মনে হচ্ছে ঘরবাড়ি ভেসে যাবে।”
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ পূর্বাভাস বলছে, সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরও ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে তিস্তা ও এর শাখা নদীগুলোর পানি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তা অববাহিকায় ভারত থেকে হঠাৎ করে অতিরিক্ত পানি ছাড়া হলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক বন্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যারাজটি এখন সর্বোচ্চ চাপে কাজ করছে। তাই এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত উজান থেকে পানির প্রবাহ কমানোর বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ জরুরি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং রেড ক্রিসেন্ট যৌথভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। রাতভর মাইকিং অব্যাহত থাকবে এবং যদি পানি আরও বৃদ্ধি পায়, তবে দুর্গতদের আশ্রয় ও খাদ্যসহায়তা কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
উত্তরাঞ্চলের মানুষের প্রত্যাশা—উজানের পানি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এবং অতিবৃষ্টির ধারা অব্যাহত থাকলে তিস্তা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকা ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে যেতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ