
ছবি: সংগৃহীত
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতনের আগে দেশব্যাপী দমন-পীড়নের অভিযোগে দায়ের করা একাধিক মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার এখন শেষ পর্যায়ে। এসব মামলার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে করা মামলাটি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সূত্র বলছে, এই মামলাসহ মোট ছয়টি মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলতি বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হতে পারে। রায় ঘোষণা হতে পারে বছরের শেষ প্রান্তে অথবা আগামী বছরের জানুয়ারিতে।
এই মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে—
১️⃣ শেখ হাসিনাসহ তিনজনের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা
২️⃣ চানখাঁরপুলে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে হত্যার মামলা
৩️⃣ আশুলিয়ায় মরদেহ পোড়ানোর মামলা
৪️⃣ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ হত্যা মামলা
৫️⃣ রামপুরায় গুলি করে হত্যার মামলা
৬️⃣ কুষ্টিয়ায় হত্যাকাণ্ডে জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে মামলা।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, ছয়টি মামলার মধ্যে অন্তত চারটির সাক্ষ্যগ্রহণ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কিছু মামলায় এখন শুধু তদন্ত কর্মকর্তার জেরা বাকি। এরপর যুক্তিতর্ক শুরু হবে এবং যুক্তিতর্ক শেষেই রায়ের দিন ধার্য করবেন ট্রাইব্যুনাল।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে চালানো ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। অভিযোগ—তারা পরিকল্পিতভাবে সারা দেশে গুলি, গ্রেফতার, নির্যাতন এবং হত্যা অভিযান পরিচালনা করেন, যা মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ চলমান এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের মোট ৫৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। সর্বশেষ সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর। বর্তমানে তার জেরা চলছে। ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, জেরা শেষ হলে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হবে।
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক থাকায় তারা সাফাই সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে তাদের পক্ষে নিয়োজিত রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীরা (অ্যামিকাস কিউরি) সীমিত সময়ের মধ্যে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন। এরপর আদালত রায়ের জন্য দিন ধার্য করবেন।
ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, “শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান কামালের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রায় শেষ। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হবে। এরপর যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার অপেক্ষা।”
প্রসিকিউশন আশা করছে, নভেম্বরের শেষ নাগাদ মামলার যুক্তিতর্ক শেষ করে ডিসেম্বরেই রায় ঘোষণা সম্ভব হতে পারে।
মামলায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম সাক্ষ্য দিয়েছেন। প্রয়াত গবেষক বদরুদ্দীন উমরের দেওয়া লিখিত জবানবন্দিও সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে ট্রাইব্যুনাল। সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন নিজেই রাজসাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। আদালতে ভিডিও ফুটেজ, কল রেকর্ড ও দলিলও প্রদর্শন করা হয়েছে, যেখানে হত্যাকাণ্ড ও নির্দেশনার প্রমাণ রয়েছে বলে দাবি প্রসিকিউশনের।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় ট্রাইব্যুনাল-১ গত ১৪ জুলাই আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। তাদের মধ্যে চারজন—ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম এবং সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল—পলাতক। বাকি চারজন—শাহবাগ থানার পরিদর্শক আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও নাসিরুল ইসলাম—কারাগারে আছেন।
এই মামলায় ইতোমধ্যে ১৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের দাবি, গুলি চালানোর প্রত্যক্ষ প্রমাণসহ সিসিটিভি ফুটেজ আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল আশা করছে, অক্টোবরের মাঝামাঝি সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হবে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সাভারের আশুলিয়ায় পাঁচজনকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে হত্যা ও ৪ আগস্ট একজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনাল-২ এ বিচার চলছে। মামলায় মোট ১৬ আসামি, তাদের মধ্যে আটজন কারাগারে, আর আটজন—including সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম—পলাতক।
এ মামলায় এখন পর্যন্ত আটজন সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামীম বলেন, “আশুলিয়ায় মরদেহ পোড়ানোর মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ দ্রুত এগোচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যে সাক্ষ্য শেষ করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন সম্ভব হবে।”
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ছিলেন জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে আন্দোলনের সময় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই মামলায় আসামি ৩০ জন, যাদের মধ্যে তৎকালীন উপাচার্য মো. হাসিবুর রশীদ, কয়েকজন শিক্ষক, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা এবং পুলিশ কর্মকর্তারা রয়েছেন।
এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে ট্রাইব্যুনাল-২ এ। গ্রেফতার হয়েছে ছয়জন আসামি, বাকিরা পলাতক। মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ধীরগতিতে এগোলেও ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হতে পারে বলে আশা প্রসিকিউশনের।
রাজধানীর রামপুরায় আন্দোলনের সময় ভবনের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করে হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। একই ঘটনায় আরও দুজন নিহত হন। ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনাল সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। এএসআই চঞ্চল সরকার গ্রেফতার আছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্যগ্রহণ ১৬ অক্টোবর থেকে শুরু হবে। এই মামলাটিও বছরের শেষ নাগাদ সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
কুষ্টিয়ায় ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও সাতজনকে হত্যার ঘটনায় জাসদ সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। প্রসিকিউশন তার বিরুদ্ধে আটটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ইনু তখনকার ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান রক্ষায় সহিংসতা ও দমন-পীড়নে মৌখিক ও কৌশলগত সমর্থন দেন, আন্দোলনকারীদের জঙ্গি বা সন্ত্রাসী বলে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন এবং শেখ হাসিনার নির্দেশনায় কারফিউ জারি ও গুলিবর্ষণের পরিকল্পনায় সহযোগিতা করেন।
এই মামলার অভিযোগ গঠন শুনানি আগামী ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে।
ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, “আমরা আশা করছি, নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে ছয়টি মামলার কার্যক্রম শেষ হবে। রায় ঘোষণার এখতিয়ার সম্পূর্ণ ট্রাইব্যুনালের, তবে প্রসিকিউশন টিম আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করছে।”
তিনি আরও জানান, “রামপুরা, আশুলিয়া ও চানখাঁরপুলের মামলাগুলোর সাক্ষ্যগ্রহণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। রংপুর ও কুষ্টিয়ার মামলাগুলোতেও অগ্রগতি ভালো। ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা সব মামলার সাক্ষ্য শেষ করতে পারবো।”
প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামীম বলেন, “সব অভিযোগ প্রমাণের মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। আশুলিয়া ও আবু সাঈদের মামলায় ডিসেম্বরেই যুক্তিতর্ক শুরু হবে। রায় ঘোষণার আগে আর বেশি সময় লাগবে না।”
সব মিলিয়ে শেখ হাসিনাসহ ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার বিচার এখন শেষ প্রান্তে। ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই বছরই দেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচিত হতে পারে। নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই যদি যুক্তিতর্ক শেষ করা যায়, তাহলে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বা ২০২৬ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে একে একে এসব মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে।
রাষ্ট্রপক্ষ বলছে—“এই রায়গুলো হবে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যেখানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার সম্পন্ন হবে এবং দায়ীরা আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ