
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা কেবলই স্থানীয় নয়—বরং এগুলোর সঙ্গে পাশের দেশের কিছু কার্যক্রম ও বার্তা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তার দাবি, ভারতের ভেতরে দুর্গাপূজার মণ্ডপে প্রধান উপদেষ্টার মতো করে তৈরি করা “অসুর প্রতিকৃতি” এবং বাংলাদেশের ভেতরে কিছু স্থানে অসুরের মুখে দাড়ি ব্যবহার—এই দুটি ঘটনাই “একই সূত্রে গাঁথা”, যার লক্ষ্য দেশে বিভ্রান্তি ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা।
রবিবার দুপুরে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক কোর কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এই মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “দুর্গাপূজায় পাশের দেশে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিকৃতি বানানো ও দেশে অসুরের মুখে দাড়ি ব্যবহার একই সূত্রে গাঁথা। এর মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্টের দোসর ও পাশের দেশ থেকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, কিছু মহল দেশে ধর্মীয় উসকানি, গুজব ও মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। “বাংলাদেশে পরিবর্তনের পর অনেকেই অখুশি হয়েছে,” তিনি বলেন।
“এখন সেই অখুশি গোষ্ঠী বাইরে বসে ভিন্ন কৌশলে দেশ destabilize করার চেষ্টা করছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়, ধর্মের আবেগ ব্যবহার করতে চায়, সামাজিক মাধ্যমে ঘৃণা ছড়াতে চায়। আমরা সেসব নজরদারিতে রেখেছি।”
তিনি জানান, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এসব ইন্ধনের উৎস ও নেপথ্যের যোগসূত্র শনাক্তে কাজ করছে। “আমরা জানি, কোথা থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, কে কার পক্ষে কাজ করছে,” বলেন জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
ব্রিফিংয়ে উঠে আসে খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি এক কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনাও, যা গত কয়েক সপ্তাহে জেলায় অস্থিরতা ও সহিংসতার জন্ম দিয়েছিল।
উপদেষ্টা বলেন, “যে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে এত তুলকালাম কাণ্ড হলো, মেডিক্যাল রিপোর্টে সেখানে কোনো ধর্ষণের আলামতই পাওয়া যায়নি। তবুও কেউ কেউ বিষয়টি ব্যবহার করে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু জনগণের সহযোগিতায় আমরা পরিস্থিতি খুব সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি।”
তিনি জানান, স্থানীয় প্রশাসন, সেনা ও পুলিশ সমন্বিতভাবে কাজ করায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লেও তা দ্রুত প্রশমিত করা গেছে। ইতোমধ্যে ৮ দিন পর খাগড়াছড়ি সদর ও গুইমারা উপজেলায় ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এটি প্রথম নয়, এর আগেও খাগড়াছড়ির সহিংসতা প্রসঙ্গে ভারতীয় সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। সেই মন্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়।
গত শুক্রবার নয়াদিল্লিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন করেন এক ভারতীয় সাংবাদিক। জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন। ভারত সবসময়ই একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চায়।”
ভারতের এই প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “আমরা কোনো দেশের সঙ্গে শত্রুতা চাই না। তবে যেকোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ড বা উসকানির প্রমাণ থাকলে তা উপেক্ষা করাও সরকারের দায়িত্ব নয়। বাংলাদেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। কিন্তু সেই সম্পর্ক যেন আমাদের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্টের হাতিয়ার না হয়—এটা নিশ্চিত করতেই আমরা সতর্ক।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি “সামগ্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আছে”। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য ও উসকানির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, তবু সরকার সেগুলো মোকাবিলায় “শক্ত অবস্থানে” রয়েছে।
তিনি বলেন, “গুজব ছড়ানো, ভুয়া ছবি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু জনগণ এখন অনেক সচেতন। কেউ চাইলেই আগের মতো উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারবে না।”
উপদেষ্টা জানান, আগামী দিনগুলোতে স্থানীয় প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে বিশেষ মনিটরিং সেল গঠন করা হবে, যাতে সীমান্তবর্তী অঞ্চলসহ সংবেদনশীল এলাকাগুলোর পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা যায়।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—সরকার এখন কেবল অভ্যন্তরীণ নয়, বরং বহিরাগত প্রভাবকেও গুরুত্ব সহকারে দেখছে। তার মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্টের জন্য যেকোনো প্রচেষ্টা—তা যতই সূক্ষ্ম বা সাংস্কৃতিক আকারে আসুক না কেন—রাষ্ট্র কঠোরভাবে মোকাবিলা করবে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক পরিণত। তারা জানে কারা বন্ধুর মুখোশে বিষ ঢালে। আমরা সবাই মিলে এই দেশকে নিরাপদ রাখব, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় কাজ।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ