
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও শান্তিকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ। কারণ, এই সময়টিই সেই প্রতীক্ষিত মৌসুম—যখন ঘোষণা করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার, নোবেল পুরস্কার। প্রথা অনুযায়ী প্রতিবছর অক্টোবরের প্রথম সোমবার থেকেই শুরু হয় নোবেল ঘোষণার সপ্তাহ। সেই ধারাবাহিকতায় আজ, সোমবার (৬ অক্টোবর ২০২৫), ঘোষণা করা হচ্ছে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর নাম।
সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট থেকে বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৩টায় ঘোষণা করা হবে চিকিৎসাশাস্ত্র বা ফিজিওলজিতে নোবেল বিজয়ীর নাম। এরপর প্রতিদিন একে একে ঘোষণা করা হবে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি এবং অর্থনীতিতে বিজয়ীদের নাম।
চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার সাধারণত এমন গবেষক বা বিজ্ঞানীকে দেওয়া হয়, যাঁদের আবিষ্কার বা গবেষণা মানুষের জীবনরক্ষা বা চিকিৎসা প্রযুক্তিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। গত কয়েক বছরে এই বিভাগে জিন সম্পাদনা, প্রতিরোধক টিকা, স্নায়ুবিজ্ঞান, ক্যানসার চিকিৎসা ও ভাইরাসবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীরা পুরস্কৃত হয়েছেন।
বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানমহলে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু—কে হচ্ছেন ২০২৫ সালের বিজয়ী? চিকিৎসা গবেষণার কোন নতুন দিগন্ত খুলে দেবে তাঁর নাম?
প্রথা অনুযায়ী, নোবেল পুরস্কার ঘোষণার ছয়টি বিভাগ ও সময়সূচি নিম্নরূপ—
-
৬ অক্টোবর (সোমবার): চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল (বিকেল ৩:৩০)
-
৭ অক্টোবর (মঙ্গলবার): পদার্থবিদ্যায় নোবেল (বিকেল ৩:৪৫)
-
৮ অক্টোবর (বুধবার): রসায়নে নোবেল (বিকেল ৩:৪৫)
-
৯ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার): সাহিত্যে নোবেল (বিকেল ৫:০০)
-
১০ অক্টোবর (শুক্রবার): শান্তিতে নোবেল (বিকেল ৩:০০)
-
১৩ অক্টোবর (সোমবার): অর্থনীতিতে নোবেল (বিকেল ৩:৪৫)
চিকিৎসা থেকে শুরু করে অর্থনীতি—প্রতিটি বিভাগে রয়েছে আলাদা আলাদা মূল্যায়ন পদ্ধতি। প্রতিটি পুরস্কার বিজয়ীকে নির্বাচিত করা হয় একাধিক দেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত নোবেল কমিটির মাধ্যমে, যারা দীর্ঘ গবেষণা, প্রমাণ যাচাই ও পর্যালোচনার মাধ্যমে সর্বাধিক অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করে থাকেন।
নোবেলের ছয়টি বিভাগের মধ্যে পাঁচটি পুরস্কার ঘোষণা করা হয় সুইডেন থেকে, তবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয় নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে। এর পেছনে রয়েছে আলফ্রেড নোবেলের নিজস্ব ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। তিনি তাঁর উইলে উল্লেখ করেছিলেন, শান্তির জন্য পুরস্কারটি পরিচালনা করবে নরওয়ের সংসদ, আর বাকি পুরস্কারগুলো পরিচালনা করবে সুইডেন। এই ঐতিহ্য আজও অপরিবর্তিত রয়েছে।
নোবেল পুরস্কারের সূচনা হয় ১৯০১ সালে। এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুইডিশ বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক ও শিল্পপতি আলফ্রেড নোবেল, যিনি বিখ্যাত ডিনামাইটের উদ্ভাবক। জীবনের শেষ সময়ে তিনি তাঁর সম্পদের একটি বড় অংশ উইল করে যান মানবকল্যাণে অসামান্য অবদান রাখা ব্যক্তি বা সংগঠনকে পুরস্কৃত করার উদ্দেশ্যে।
তাঁর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর, ১৯০১ সালে প্রথমবার দেওয়া হয় চিকিৎসা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (দ্য ব্যাংক অব সুইডেন) অর্থনীতিতে অসামান্য অবদানের জন্য একটি নতুন পুরস্কার ঘোষণা করে, যা আনুষ্ঠানিকভাবে “নোবেল স্মৃতিতে অর্থনীতিতে পুরস্কার” নামে পরিচিত। যদিও এটি আলফ্রেড নোবেলের মূল উইলে ছিল না, তবুও মর্যাদা ও সম্মাননার দিক থেকে অন্যান্য পুরস্কারের সমান গুরুত্ব বহন করে।
প্রতিটি নোবেল বিজয়ীকে দেওয়া হয়—
-
১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রাউন (প্রায় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার),
-
একটি স্বর্ণপদক, এবং
-
একটি মানপত্র।
২০২৩ সালে সুইডিশ ক্রোনারের মূল্যস্ফীতির কারণে প্রাইজমানি ১০ মিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি করে ১১ মিলিয়ন ক্রোনার করা হয়, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ পরিমাণ পুরস্কার অর্থ।
প্রথা অনুযায়ী, প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর, আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে, বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। স্টকহোমে অনুষ্ঠিত হয় চিকিৎসা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, সাহিত্য ও অর্থনীতির পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, আর একই দিনে অসলোতে অনুষ্ঠিত হয় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান।
অনুষ্ঠানে রাজা কার্ল ষোড়শ গুস্তাফ নিজ হাতে বিজয়ীদের স্বর্ণপদক ও সনদ প্রদান করেন। এদিন বিশ্বের শীর্ষ বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, কূটনীতিক ও রাজনীতিকরা যোগ দেন এক অনাড়ম্বর অথচ ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানে।
নোবেল ঘোষণার দিনগুলো এখন বিশ্বব্যাপী এক প্রকারের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎসবে পরিণত হয়। গবেষক, শিক্ষার্থী ও সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি থাকে স্টকহোম ও অসলোতে। বিভিন্ন দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও ল্যাবরেটরিতে চলছে আলোচনা—এই বছরের পুরস্কার কার ঝুলিতে যাচ্ছে?
বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক চিকিৎসা গবেষণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর ডায়াগনস্টিকস, জিনোম সম্পাদনা, স্নায়ু পুনর্জন্ম, এবং ক্যানসার প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীরা রয়েছেন আলোচনায়।
নোবেল পুরস্কার আজও মানবসভ্যতার সর্বোচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জনের প্রতীক। শুধু আর্থিক পুরস্কার নয়, এটি এমন একটি সম্মান যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে।
আজ বিকেলেই জানা যাবে—২০২৫ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে সেই সর্বোচ্চ সম্মান কার হাতে যাচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ