
ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরাসরি আহ্বান উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় বোমা বর্ষণ অব্যাহত রেখেছে দখলদার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। শনিবার দিনভর চলা ভয়াবহ বিমান ও আর্টিলারি হামলায় অন্তত ৭০ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের অধিকাংশই সাধারণ নাগরিক। কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এটি অন্যতম ভয়াবহ বোমা হামলার দিন ছিল।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ইসরায়েলি বিমানগুলো ভোর থেকে রাত পর্যন্ত গাজার উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় অবিরাম হামলা চালায়। গাজার রাজধানী শহরেই অন্তত ৪৫ জন নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই দুর্ভিক্ষ ও অবরোধে জর্জরিত সাধারণ মানুষ। এক চিকিৎসক বলেন, “যারা আগে থেকেই খাদ্য আর ওষুধের অভাবে কষ্ট পাচ্ছিল, এখন তাদের ওপর পড়ছে বোমা।”
গাজা শহরের তুফাহ এলাকায় একাধিক যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বোমা একটি ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক ভবনে আঘাত হানে। মুহূর্তের মধ্যেই ভবনটি ধসে পড়ে, চারপাশের বাড়িঘরও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্থানীয় বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা জানিয়েছে, কেবল ওই ভবনেই ১৮ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে রয়েছে দুই মাস বয়সী একটি শিশু থেকে শুরু করে আট বছর বয়সী সাতটি শিশু। সংস্থার মুখপাত্র বলেন, “আমরা ধ্বংসস্তূপ থেকে ছোট ছোট দেহ উদ্ধার করছি—তাদের কেউ নামাজ পড়ছিল, কেউ ঘুমাচ্ছিল।”
দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসি এলাকায়ও ইসরায়েলি বাহিনী একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এখানকার একটি বাস্তুচ্যুত শরণার্থী শিবিরে হামলায় অন্তত আটজন আহত হন, যাদের মধ্যে দুইজন শিশু। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই আল-মাওয়াসি অঞ্চলকেই ইসরায়েল পূর্বে “নিরাপদ অঞ্চল” হিসেবে ঘোষণা করেছিল, এবং হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে এই এলাকাতেই আশ্রয় নিতে নির্দেশ দিয়েছিল। অথচ সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে এই অঞ্চলও ক্রমাগত ইসরায়েলি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে।
আল জাজিরার সাংবাদিক হিন্দ খোদারি, যিনি বর্তমানে গাজার মধ্যাঞ্চলের আজ-জাওয়ায়েদা এলাকায় অবস্থান করছেন, জানিয়েছেন যে শুধু গাজা শহরই নয়, নুসাইরাত শরণার্থী শিবির এবং আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায়ও ভয়াবহ বিমান হামলা হয়েছে। তিনি বলেন, “রাতজুড়ে আকাশে ড্রোন ও যুদ্ধবিমানের শব্দে ঘুম নেই কারও। প্রতিটি মুহূর্তে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মানুষ আতঙ্কে ঘরের ভেতরও নিরাপদ বোধ করছে না।”
তিনি আরও জানান, আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো কোনো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। গাজার হাসপাতালগুলো জ্বালানি সংকটে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় ইনকিউবেটর, অস্ত্রোপচার কক্ষ ও জরুরি ইউনিটগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একে একে। এক চিকিৎসক বলেন, “আমরা অনেক সময় মোবাইলের আলোয় অপারেশন করছি, কারণ জেনারেটরের জন্য পর্যাপ্ত তেল নেই।”
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করছে, তারা “হামাসের অবকাঠামো” ও “সন্ত্রাসী ঘাঁটি” লক্ষ্য করছে। কিন্তু বাস্তবে যেসব এলাকা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে, সেগুলোর অধিকাংশই সাধারণ জনগণের আবাসিক এলাকা, স্কুল, শরণার্থী ক্যাম্প ও বাজার। স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, চলমান যুদ্ধের ১১তম মাসে গাজায় মোট নিহতের সংখ্যা ৪১ হাজার ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই শিশু ও নারী।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেন, “এখন সময় এসেছে অস্ত্র থামানোর। গাজায় নিরীহ মানুষের মৃত্যু বন্ধ করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “আমেরিকা ইসরায়েলের নিরাপত্তার পাশে আছে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে শিশু ও নারীদের ওপর বোমা পড়বে।”
তবে ট্রাম্পের এই বক্তব্যের পরপরই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, “আমরা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলব না।” তার ভাষায়, “হামাস যতদিন অস্ত্র রাখবে, ততদিন আমাদের অভিযান চলবে।” ফলে স্পষ্ট হয়ে গেছে, ওয়াশিংটনের চাপ ও আন্তর্জাতিক আহ্বানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই ইসরায়েল গাজায় অভিযান অব্যাহত রাখবে।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় দপ্তর (OCHA) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গাজার পরিস্থিতি “মানবিক বিপর্যয়ের পর্যায়ে পৌঁছেছে।” সেখানে বলা হয়, “গাজায় পানি, খাদ্য ও ওষুধের মজুদ প্রায় শেষ। হাসপাতালগুলো কার্যত মৃতপ্রায় অবস্থায়, আর হাজার হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে।” সংস্থাটি ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতি ও ত্রাণ চলাচল অবাধ রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস’-এর এক সদস্য বলেন, “আমরা গাজার উত্তর অংশে কিছু এলাকায় প্রবেশ করতে পারছি না। রাস্তাগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। আহতদের অনেককেই রাস্তার পাশে মৃত্যু বরণ করতে হচ্ছে।”
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন “ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়।” তার মতে, “এটা কোনো যুদ্ধ নয়, এটা গণহত্যা।”
গাজা সিটির দক্ষিণে একজন শিক্ষক, যিনি নিজের পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হারিয়েছেন, বলেন, “আমরা কোথায় যাব? ইসরায়েল বলে এখানে নিরাপদ, কিন্তু এখানেই তারা বোমা ফেলছে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের আহ্বান আসলে মার্কিন প্রশাসনের “দ্বৈত নীতি”রই একটি নমুনা। একদিকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান, অন্যদিকে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ—এই দুইয়ের মধ্যে আমেরিকার অবস্থান স্পষ্টভাবে দ্বন্দ্বপূর্ণ।
এই পরিস্থিতিতে গাজায় মানবিক সংকট আরও গভীর হচ্ছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে প্রায় ১৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত। তাদের অনেকেই এখন “নিরাপদ অঞ্চল” হিসেবে ঘোষিত এলাকাগুলোর শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছেন—যেগুলোও হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
সব মিলিয়ে, ট্রাম্পের কূটনৈতিক আহ্বান কাগজে থাকলেও গাজার আকাশে এখনো অবিরাম বোমার শব্দ। ইসরায়েল বলছে “এটা নিরাপত্তার অভিযান”, কিন্তু বাস্তবতা হলো—বোমার নিচে পিষ্ট হচ্ছে শত শত নিরীহ নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানেও থামছে না আগুন, বরং গাজা এখন রক্ত, ধ্বংস আর কান্নার উপত্যকায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ