
ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধবিরতি আসলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুরই “বিজয়”। শনিবার (৫ অক্টোবর) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম অ্যাক্সিওস–কে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প এই মন্তব্য করেন। তিনি জানান, গাজা যুদ্ধের অবসান ও যুদ্ধবিরতির জন্য তিনি নেতানিয়াহুকে কোনো বিকল্প দেননি—বরং সরাসরি বলেছিলেন, “বিবি, এটি তোমারই বিজয়ের সুযোগ।”
ট্রাম্পের মতে, ইসরায়েল বর্তমানে যে যুদ্ধবিরতির পথে হাঁটছে, তা কোনো পরাজয়ের ফল নয়; বরং কূটনৈতিকভাবে অর্জিত এক বিজয়, যা নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক দৃঢ়তা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সমর্থনের ফলাফল।
ট্রাম্প সাক্ষাৎকারে জানান, শুক্রবার নেতানিয়াহুর সঙ্গে তাঁর এক গুরুত্বপূর্ণ ফোনালাপ হয়, যেখানে তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে গাজা যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা মেনে নিতে অনুরোধ করেন। তাঁর ভাষায়, “আমি তাকে বলেছি, এটা মানতেই হবে। আমার সঙ্গে থাকলে, তোমাকে এটা মানতেই হবে।”
ট্রাম্প আরও বলেন, “বিবি (নেতানিয়াহু) গাজার ব্যাপারটা অনেক দূর নিয়ে গিয়েছিল। এতে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক সমর্থন হারিয়েছে। এখন আমার লক্ষ্য হচ্ছে সেই সমর্থন আবার ফিরিয়ে আনা।”
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাঁর কূটনৈতিক তৎপরতা এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের ফলেই গাজা সংঘাতের অবসানের পথ প্রশস্ত হয়েছে।
ট্রাম্পের মন্তব্যটি প্রকাশের পরপরই হোয়াইট হাউসের ‘র্যাপিড রেসপন্স ৪৭’ নামের এক্স (পূর্বে টুইটার) অ্যাকাউন্ট থেকে উদ্ধৃতিটি শেয়ার করা হয়। সেই পোস্টে বলা হয়, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বেই গাজা যুদ্ধের কূটনৈতিক সমাধানের পথ তৈরি হয়েছে।”
ওই সময়েই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইসরায়েলি জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে গাজা যুদ্ধবিরতির পক্ষে তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, “আমি এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মিলে এমন একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছি, যা শুধু গাজা নয়, গোটা অঞ্চলের পরিস্থিতি পাল্টে দেবে।”
নেতানিয়াহুর ভাষ্যমতে, এই পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো—ইসরায়েলকে বিশ্বমঞ্চে বিচ্ছিন্ন না করে বরং হামাসকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। তাঁর মতে, “যুদ্ধের পর ইসরায়েলকে একা নয়, বরং আরও সমর্থিত অবস্থায় দাঁড় করানোর পথ খুলে দিয়েছে এই সমঝোতা।”
অ্যাক্সিওসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, “অনেকেই মনে করছে এটা কোনো ছাড় বা আত্মসমর্পণ। কিন্তু আমি বলব, এটা নেতানিয়াহুরই বিজয়। কারণ সে জানে কখন থামতে হবে এবং কিভাবে পরিস্থিতিকে নিজের পক্ষে নিতে হয়।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমি নেতানিয়াহুকে বলেছিলাম—এই যুদ্ধ এখন বন্ধ করার সময়। তিনি আমার সঙ্গে একমত হন। তিনি জানেন, অতিরিক্ত সামরিক অভিযান এখন আর কোনো সমাধান আনবে না, বরং ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে করে দেবে।”
ট্রাম্প বলেন, “গাজার পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল, যেখানে ইসরায়েল বিশ্বের অনেক সমর্থন হারিয়েছিল। কিন্তু আমি সেই সমর্থন ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি। আমি চাই, বিশ্ব আবার ইসরায়েলকে ন্যায়সঙ্গত অবস্থানে দেখুক।”
তিনি আরও জানান, তাঁর প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় রয়েছে এবং এতে যুক্ত হয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ট্রাম্প বলেন, “ইসরায়েলের বন্ধু হিসেবে আমি চাই তারা শক্তিশালী থাকুক, কিন্তু একই সঙ্গে শান্তির পথে চলুক। যুদ্ধ শেষ করেই আসল বিজয় পাওয়া যায়।”
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেও এই কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় ট্রাম্পের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। ইসরায়েলি গণমাধ্যম ইয়েদিয়োথ আহরনোথ–কে দেওয়া এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু বলেন, “ট্রাম্প ও আমি মিলে এমন এক পরিকল্পনা করেছি যা শুধু যুদ্ধ থামায়নি, বরং হামাসকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও কোণঠাসা করেছে। গাজার যুদ্ধবিরতি ইসরায়েলকে দুর্বল করেনি, বরং কূটনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই চুক্তি ইসরায়েলকে একা ফেলে দেয়নি, বরং হামাসকে একা করে দিয়েছে। এখন বিশ্বের অনেক দেশ বুঝতে পারছে, সন্ত্রাসের রাজনীতি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।”
সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানেরও প্রশংসা করেন। তাঁর ভাষায়, “এরদোয়ান অনেক সাহায্য করেছেন। তিনি শক্ত মানুষ, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি আমার বন্ধু। এই পুরো প্রক্রিয়ায় তিনি দারুণ ভূমিকা রেখেছেন।”
ট্রাম্প বলেন, “এরদোয়ান পরিস্থিতি শান্ত করতে বেশ সক্রিয় ছিলেন। আমি তাঁর সঙ্গে কয়েকবার কথা বলেছি। তিনি সত্যিই এই সমঝোতাকে সম্ভব করতে সাহায্য করেছেন।”
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই বক্তব্য শুধুমাত্র কূটনৈতিক নয়, রাজনৈতিকভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৬ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে ট্রাম্প ইসরায়েলপন্থী ভোটারদের প্রতি তাঁর দৃঢ় অবস্থান পুনরায় প্রদর্শন করতে চাইছেন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মার্ক ল্যাভিন বলেন, “ট্রাম্পের এই বক্তব্য নির্বাচনী কৌশলের অংশ। তিনি দেখাতে চান, তাঁর নেতৃত্বেই ইসরায়েল শান্তি ও নিরাপত্তার পথে ফিরে এসেছে।”
অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিশ্লেষক নাদিয়া খলিফা বলেন, “গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর এই ঘনিষ্ঠ সমন্বয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করবে। কারণ, অনেক দেশ এখনো মনে করছে এই যুদ্ধবিরতি হামাসের পরাজয়ের চেয়ে ইসরায়েলের কৌশলগত পুনর্বিন্যাস।”
সবমিলিয়ে গাজা যুদ্ধবিরতিকে ঘিরে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর এই পারস্পরিক সমর্থন মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন বার্তা দিয়েছে। ট্রাম্প নিজেকে এই সমঝোতার মূল প্রেরণা হিসেবে উপস্থাপন করছেন, অন্যদিকে নেতানিয়াহু দেখাতে চাইছেন যে, যুদ্ধবিরতি কোনো পরাজয় নয়, বরং কৌশলগত সাফল্য।
গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর অঞ্চলটিতে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে—যেখানে একদিকে হামাসের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েল নতুন কূটনৈতিক মিত্রতা পুনর্গঠনের পথে এগোচ্ছে। আর এই পুরো প্রক্রিয়াকে ট্রাম্পের ভাষায় “একটি পরিকল্পিত বিজয়”—যেখানে বিজয়ীর নাম বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
বাংলাবার্তা/এমএইচ