
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় এসেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং খুব শিগগিরই আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হবে। এ বক্তব্যকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘোষণা হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ স্বাধীনতার পর এই প্রথম কোনো বড় রাজনৈতিক দলকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে।
রবিবার বিকেলে ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর সংবাদ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, “আমাদের কাছে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এনডিএম—অর্থাৎ ববি হাজ্জাজের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন—আগেই একটি লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছে। আমরা সেটির প্রাথমিক যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করছি। খুব দ্রুতই তদন্ত ইনিশিয়েট বা শুরু হবে।”
প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, এনডিএমের অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগের কিছু শীর্ষস্থানীয় নেতা, তাদের সহযোগী সংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দিষ্ট অংশ একত্রে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। অভিযোগে বলা হয়, ওই সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্বিচারে হত্যা, গুম, নির্যাতন এবং অসংখ্য নিরীহ নাগরিকের ওপর দমনপীড়ন চালানো হয়।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “অভিযোগ এসেছে, আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। প্রাথমিকভাবে তথ্য-প্রমাণ যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে, এখন সাক্ষ্য ও প্রমাণ সংগ্রহের আনুষ্ঠানিক ধাপে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। বলা যায়, খুব শিগগিরই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকলে আইন অনুযায়ী তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। এটি কেবল ব্যক্তি নয়, সংগঠন হিসেবেও দায়বদ্ধতার আওতায় আনার এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।”
ব্রিফিং চলাকালে এক সাংবাদিক প্রশ্ন তোলেন—সম্প্রতি বরিশালে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেছেন, ‘শিগগিরই এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনা নেই’, বরং দলটির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া এগোচ্ছে।
প্রতিক্রিয়ায় তাজুল ইসলাম বলেন, “আইন উপদেষ্টা কী বলেছেন, সে বিষয়ে মন্তব্য করা আমার দায়িত্ব নয়। তবে আমরা যে প্রক্রিয়া চালাচ্ছি, তা সম্পূর্ণ আইনি কাঠামোর মধ্যে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগগুলোর যাচাই-বাছাই শেষে তদন্ত শুরু হবে। তখনই বোঝা যাবে দল হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে বিচারের বিষয়টি কতদূর অগ্রসর হচ্ছে।”
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্তের এই ঘোষণা এমন এক সময় এলো, যখন গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩-এ বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনে। ওই বছরের ২৫ নভেম্বর প্রথম দফায় একটি অধ্যাদেশ জারি করে আইনটিতে সংশোধন আনা হয়। পরবর্তীতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবির মুখে আবারও সংশোধনী আনা হয়, যাতে দল বা সংগঠন হিসেবেও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার সম্ভব হয়।
চলতি বছরের ১১ মে দ্বিতীয়বারের মতো “অধিকতর সংশোধন” এনে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এই সংশোধনীতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—যদি কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন গণহত্যা, হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন বা মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত প্রমাণিত হয়, তাহলে ট্রাইব্যুনাল সেই দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে পারবে। পাশাপাশি দলটির নিবন্ধন বাতিল, সম্পদ বাজেয়াপ্ত, এমনকি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা জারির ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালকে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ২ ও ২০ ধারায় যুক্ত নতুন উপধারাগুলো মূলত সংগঠনের সংজ্ঞা ও শাস্তির বিষয়টি নির্দিষ্ট করেছে।
ধারা ২-এ বলা হয়েছে—‘সংগঠন বলতে বোঝায় যেকোনো রাজনৈতিক দল বা এর অধীনস্থ, সম্পৃক্ত বা যুক্ত কোনো সত্ত্বা; অথবা এমন কোনো গোষ্ঠী যা উক্ত দলের কর্মকাণ্ডকে প্রচার, সমর্থন বা সহায়তা করে।’
অন্যদিকে ধারা ২০(খ)-তে বলা হয়েছে—‘যদি ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রতীয়মান হয় যে কোনো সংগঠন এই আইনের ধারা ৩(২)-এর অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে নির্দেশ, উসকানি, ষড়যন্ত্র, সহায়তা বা প্ররোচনা দিয়েছে, তবে ট্রাইব্যুনাল সেই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার, এর নিবন্ধন বা লাইসেন্স বাতিল করার এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রাখে।’
এই ধারা কার্যকর হলে আওয়ামী লীগ শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, আইনগতভাবেও বড় ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ দল হিসেবে বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের সাংগঠনিক অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা এবং সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আইনি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তদন্ত শুরু হলে এটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো শাসক দলকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারের আওতায় আনার ঘটনা।
একজন সাবেক প্রসিকিউটর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এটি শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এক নজিরবিহীন অধ্যায় হবে। তদন্ত প্রমাণিত হলে দলটির ওপর নিষেধাজ্ঞা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের মতো কঠোর ব্যবস্থা আসতে পারে।”
অন্যদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতায় এই তদন্ত শুরু হলে দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যে বড় প্রভাব পড়বে। অনেকের মতে, এটি বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক কাঠামো তৈরির সূচনা নির্দেশ করতে পারে।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের ঘোষণায় স্পষ্ট হয়েছে, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আর শুধু রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং তা এখন আনুষ্ঠানিক আইনি প্রক্রিয়ায় রূপ নিচ্ছে। তদন্ত শুরু হলে এটি শুধু একটি দলের নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনীতি ও ন্যায়বিচারের নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ