
ছবি: সংগৃহীত
নেপালে কয়েকদিন ধরে চলমান টানা বর্ষণে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসে দেশজুড়ে প্রাণহানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে অন্তত ৩৯ জনে। নিখোঁজ রয়েছেন আরও ১১ জন, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৩ জন। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে, সড়ক ও সেতু ভেঙে গেছে, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, আবহাওয়া পরিস্থিতি অনুকূলে না এলে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
দ্য কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেপাল পুলিশ সদর দপ্তর শনিবার (৫ অক্টোবর) সকালে এক বিবৃতিতে জানায়, শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় ও পার্বত্য এলাকায় ভয়াবহ ভূমিধস ও নদী উপচে বন্যা দেখা দেয়। কোশি ও মধেশ প্রদেশের একাধিক জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মৃতদের মধ্যে কোশি প্রদেশের ৩৬ জন এবং মধেশ প্রদেশের ৩ জন রয়েছেন।
সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি জেলা ইলামে। সেখানে একাধিক স্থানে পাহাড় ধসে ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও সড়ক মাটিচাপা পড়ে গেছে। স্থানীয় প্রশাসনের হিসাবে, শুধু ইলামেই ২৭ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা গেছে। অন্তত পাঁচজন এখনো নিখোঁজ। কয়েকটি পরিবার পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু ক্রমাগত বৃষ্টিপাতের কারণে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে।
ইলামের জেলা প্রশাসক রবি রাও বলেন, “ভূমিধসের কারণে অন্তত তিনটি গ্রাম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রাস্তাগুলো বন্ধ থাকায় উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হচ্ছে। সেনা ও পুলিশ সদস্যরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।”
উদয়পুর জেলায় বন্যা ও ভূমিধসের ঘটনায় দুইজনের মৃত্যু এবং একজন আহত হয়েছেন। খোটাং জেলায় বজ্রপাতে একজন নিহত এবং তিনজন আহত হয়েছেন। ভোজপুরেও বজ্রপাতে আরও দুজন আহত হয়েছেন।
অন্যদিকে পঞ্চথর জেলায় একটি ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ছয়জন নিহত ও ছয়জন আহত হন। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় পিচ্ছিল অবস্থায় গাড়িটি খাদে পড়ে যায় বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ।
মধেশ প্রদেশের রানিরহাট এলাকায় বজ্রপাতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। বরায় একজন, রাসুয়ায় চারজন এবং রাজধানী কাঠমান্ডুতে নদীতে ভেসে গিয়ে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। মাকোয়ানপুরে বজ্রপাতে একজন আহত হয়েছেন।
দেশটির আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, সাম্প্রতিক বর্ষণে প্রধান প্রধান নদীগুলোর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। বিশেষ করে কোশি, মহাকালী ও বাগমতী নদীর পানি প্রবল স্রোতে আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রবেশ করেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা নিরাপদ স্থানে সরে যাচ্ছেন। শতাধিক পরিবার সরকারি স্কুল ও অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে।
নেপাল পুলিশের মুখপাত্র ডিআইজি কুবের কথর বলেন, “আমাদের উদ্ধার দলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কাজ করছে। অনেক স্থানে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, ফলে আমরা হেলিকপ্টার ব্যবহার করছি। এখনো কয়েকটি এলাকা পুরোপুরি অগম্য।”
নেপালের সেনাবাহিনী, সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী (এপিএফ) এবং রেড ক্রসের সদস্যরা যৌথভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নিখোঁজদের খোঁজে অভিযান চলছে।
ইলাম, উদয়পুর ও রাসুয়া জেলার দুর্গম অঞ্চলে ভারী যন্ত্রপাতি পাঠানো হয়েছে ধসে যাওয়া রাস্তা পরিষ্কার ও মৃতদেহ উদ্ধারের জন্য। সেনা সূত্র জানায়, অন্তত ৩০টি বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে এবং আরও শতাধিক বাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিক প্রণব রাই বলেন, “ইলামের কিছু এলাকা এখনো বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্কবিহীন। আমরা বাইরে বিশ্বের সঙ্গে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। খাবার ও পানির সংকটও দেখা দিয়েছে।”
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস এবং জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সংস্থা (UNOCHA) ইতোমধ্যে নেপালের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে জরুরি সহায়তা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। সংস্থাগুলোর মতে, টানা বৃষ্টির কারণে ভূমিধসের ঝুঁকি আরও বাড়ছে এবং ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি।
UNOCHA-র দক্ষিণ এশিয়া সমন্বয়ক মাইকেল হেনরি বলেন, “নেপালের পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টিপাত এখনো অব্যাহত। আমাদের দল প্রস্তুত রয়েছে। উদ্ধারকাজে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও চিকিৎসাসামগ্রী পাঠানো হচ্ছে।”
নেপালের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এর ফলে আরও বন্যা ও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়ে গেছে। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য জেলা—ইলাম, তাপলেজং, পাঞ্চথর, খোটাং, সোলুখুম্বু ও উদয়পুরে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
অধিদপ্তরের মুখপাত্র বৃষ্ণ প্রসাদ উপাধ্যায় বলেন, “বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নদীর পানি আরও বাড়বে। তাই মানুষকে নিচু এলাকা থেকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে যেতে বলা হচ্ছে।”
নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল (প্রচণ্ড) নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং দ্রুত ত্রাণ কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। সরকার নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও আহতদের চিকিৎসার ব্যয় বহনের ঘোষণা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, “সরকার সব ধরনের উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে সেনা, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছে। দেশের যেকোনো অঞ্চলে মানুষের জীবন বাঁচানোই এখন অগ্রাধিকার।”
নেপালে বর্ষার মৌসুম এখনো শেষ হয়নি, আর টানা বৃষ্টিপাতের ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। পাহাড়ি দেশ হওয়ায় নেপাল প্রতি বছরই বর্ষাকালে বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকিতে থাকে, কিন্তু এবারের ক্ষয়ক্ষতি সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম।
অবিরাম বৃষ্টি ও দুর্যোগে গোটা দেশজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। উদ্ধারকাজ চললেও নতুন করে ভূমিধসের আশঙ্কা পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে। প্রশাসন বলছে, আবহাওয়া অনুকূলে এলে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করা সম্ভব হবে।
একজন উদ্ধারকর্মীর ভাষায়—“প্রতিটি পাহাড় এখন নড়বড়ে হয়ে আছে, আর প্রতিটি পরিবার ভয় নিয়ে রাত কাটাচ্ছে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ