
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় দীর্ঘ এক বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসানের সম্ভাবনা আবারও সামনে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ঘোষণার মাধ্যমে। গাজা থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের সম্ভাব্য রোডম্যাপ (পথনকশা) প্রকাশ করে তিনি দাবি করেছেন— “এটাই হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির সূচনা।” ট্রাম্পের প্রস্তাবে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, হামাস যদি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় এবং বন্দি বিনিময়ের প্রক্রিয়া শুরু করে, তবে ইসরাইল ধাপে ধাপে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করবে।
রোববার (৫ অক্টোবর) দ্য টাইমস অব ইসরাইল ও আল জাজিরা সূত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প তার নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম Truth Social-এ এই রোডম্যাপ প্রকাশ করেন। এতে গাজার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, ইসরাইলি সেনাদের প্রত্যাহারের প্রাথমিক সীমারেখা এবং বন্দি বিনিময় প্রক্রিয়ার ধাপগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
ট্রাম্প তার বার্তায় লিখেছেন, “হামাস নিশ্চিত করলেই যুদ্ধবিরতি সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হবে। বন্দি বিনিময় শুরু হবে এবং আমরা পরবর্তী ধাপের প্রত্যাহারের প্রস্তুতি নেব— যা আমাদের তিন হাজার বছরের এই বিপর্যয়ের অবসানের দিকে নিয়ে যাবে।”
তিনি দাবি করেন, ইসরাইল ইতিমধ্যেই এই সীমারেখায় নীতিগতভাবে সম্মতি দিয়েছে। এখন কেবল হামাসের আনুষ্ঠানিক সম্মতির অপেক্ষা। ট্রাম্পের ভাষায়, “এই মুহূর্তে শান্তির দরজা খোলা। যদি উভয় পক্ষ মানবতার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে গাজা আবারও মানুষের জন্য বাঁচার জায়গা হতে পারে।”
আরেক পোস্টে তিনি তেল আবিবে বন্দি বিনিময়ের দাবিতে অনুষ্ঠিত বিশাল এক গণবিক্ষোভের ছবি শেয়ার করেন, যেখানে বড় একটি ব্যানারে লেখা ছিল— ‘এখন না হলে আর কখনো নয়।’ ট্রাম্প মন্তব্য করেন, “এটাই ইসরাইলিদের প্রকৃত বার্তা— তারা যুদ্ধ নয়, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা চায়।”
রোববার কাতার, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক, সৌদি আরব ও মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এক যৌথ বিবৃতিতে ট্রাম্পের প্রস্তাবকে ইতিবাচক বলে অভিহিত করেন। তারা বলেন, “গাজায় যুদ্ধের অবসান, সব বন্দি— জীবিত বা মৃত— মুক্তি, এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার আলোচনার তাৎক্ষণিক সূচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাব অনুযায়ী হামাসের নেওয়া পদক্ষেপকে আমরা স্বাগত জানাই।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, গাজায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক পুনরায় দায়িত্বগ্রহণ, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি, এবং মানবিক সাহায্যের বাধাহীন প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান বলেন, “এটি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এটা শুধু গাজার নয়, পুরো অঞ্চলের শান্তির নতুন অধ্যায় হবে।”
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের ঘোষণাটি যতই প্রতিশ্রুতিশীল শোনাক না কেন, বাস্তবায়ন এখনো বড় প্রশ্ন। পরিকল্পনায় কয়েকটি সংবেদনশীল ধারা রয়েছে— যেমন হামাসের আংশিক নিরস্ত্রীকরণ, ৪৮ জন ইসরাইলি বন্দি মুক্তি এবং গাজার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর। এসব শর্তে হামাস সম্মত হবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।
টাইমস অব ইসরাইলের প্রতিবেদনে বলা হয়, হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর অভ্যন্তরীণ আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। এক অংশ এই রোডম্যাপকে ‘সম্ভাব্য অগ্রগতি’ বলে দেখছে, অন্য অংশ বলছে, “ইসরাইলি সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহার না করলে আলোচনা অর্থহীন।”
এদিকে সৌদি টেলিভিশন চ্যানেল আশারক-এর তথ্য অনুযায়ী, হামাসের প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যেই আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলের অন্যতম জ্যেষ্ঠ নেতা খলিল আল-হাইয়া আসন্ন প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন বলে জানা গেছে। তিনি ও তার প্রতিনিধি দল রোববার কায়রো পৌঁছাবেন এবং সেখান থেকে শার্ম আল-শাইখে আলোচনায় অংশ নেবেন।
গত মাসে দোহায় ইসরাইলি বিমান হামলায় আল-হাইয়াকে লক্ষ্যবস্তু করা হলেও তিনি বেঁচে যান; তবে ওই হামলায় তার ছেলে নিহত হন। সম্প্রতি কাতারের আল আরাবি টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমরা আশা করি আমাদের শহিদদের রক্ত বৃথা যাবে না। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের বিজয়ের পথ খুলে দেবে— জেরুসালেমের পথে, দখলদারের অপমানের শেষে।”
তিনি ইঙ্গিত দেন, হামাস আলোচনার দরজা বন্ধ করছে না, তবে তাদের শর্ত হলো— “গাজার জনগণের সার্বভৌমত্ব ও আত্মসম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।”
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে ট্রাম্পের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন, তবে সতর্ক করে বলেন, “যে কোনো শান্তি প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে থাকতে হবে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন।” ইউরোপীয় ইউনিয়নও এই প্রস্তাবের বিষয়ে ‘সতর্ক আশাবাদ’ প্রকাশ করেছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প এই উদ্যোগের মাধ্যমে নির্বাচনের আগে নিজেকে আবারও ‘শান্তি প্রতিষ্ঠাতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। তবে একই সঙ্গে অনেকে আশঙ্কা করছেন, ইসরাইলি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই রোডম্যাপ নিয়ে বিরোধ দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার অতি-ডানপন্থী অংশের আপত্তি থাকায়।
আগামী সপ্তাহে কায়রো ও দোহায় একাধিক পর্যালোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে কাতার, মিশর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হামাসের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদি হামাস রাজি হয়, তাহলে প্রথম ধাপে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার শুরু হতে পারে গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে, যেখানে সংঘাত সবচেয়ে তীব্র ছিল।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, “এটি যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে চলমান রক্তপাতের অবসান ঘটতে পারে এবং গাজা পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক তহবিল সক্রিয় হতে পারে।”
তবে অনেকেই মনে করছেন, রাজনৈতিক বাস্তবতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও পুরোনো ক্ষোভ এই পরিকল্পনাকে জটিল করে তুলতে পারে। শান্তির রোডম্যাপ প্রকাশ হলেও, সেটি বাস্তবায়নের পথ এখনো কাঁটায় ভরা।
সার্বিকভাবে, মধ্যপ্রাচ্যের দৃষ্টি এখন ট্রাম্পের ঘোষিত রোডম্যাপের দিকে— এটি কি সত্যিই যুদ্ধের অবসান আনবে, নাকি নতুন করে কূটনৈতিক নাটকীয়তার জন্ম দেবে, তা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব।
বাংলাবার্তা/এমএইচ