
ছবি: সংগৃহীত
দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন চরম উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম—কোথাও শান্তি নেই, নেই মানুষের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ধর্ষণ—সব ধরনের অপরাধ এখন প্রতিদিনের বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। জনগণ যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে চাইছে, ঠিক তখনই অপরাধের গ্রাফ ছুঁই ছুঁই করছে এক ভয়াবহ মাত্রা।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার সময় জনমনে এক ধরনের আশা তৈরি হয়েছিল—অবশেষে হয়তো আইনের শাসন ফিরবে, পুলিশের মনোবল বাড়বে, সন্ত্রাসীরা ধরাশায়ী হবে। কিন্তু সেই আশার প্রতিফলন ঘটেনি বাস্তবে। বরং সরকারের ১৩ মাস পার হলেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক নয়। দেশের সাধারণ মানুষ যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, তেমনি ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক থেকে শুরু করে ছাত্ররাও চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের ভয়ে দিন কাটাচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান এক ভয়ংকর চিত্র ফুটিয়ে তুলছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে দেশে মোট চার হাজার ৩১৬টি খুন ও দস্যুতার মামলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৫৪০টি মামলা। এর আগের বছর মাসিক গড় মামলা ছিল ৪৪৫টি। তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে—প্রতি মাসে ৯৫টি বেশি মামলা হয়েছে হত্যাকাণ্ড, ডাকাতি, নারী ও শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনায়।
আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, শুধু হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ২০২৪ সালের তুলনায় প্রায় ১৮ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় এই বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শুধু পরিসংখ্যান নয়—এটি সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক সংকট ও প্রশাসনিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ।
অন্যদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১৩ মাসে দেশে ৩৯ হাজার ৯৩৬টি অপরাধ মামলা হয়েছে, অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৩,০৭২টি মামলা। গড়ে প্রতিদিন ১০০টিরও বেশি মামলা দায়ের হচ্ছে হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ বিভিন্ন ঘটনায়।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা দায়ী নয়। বেকারত্ব, সামাজিক বৈষম্য, মাদকাসক্তি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা—সবই এই চিত্রের মূল কারণ।”
তিনি মনে করেন, শুধু পুলিশের অভিযান বা গ্রেপ্তার দিয়ে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। “যতক্ষণ পর্যন্ত সামাজিক সচেতনতা, দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি না হবে, ততক্ষণ অপরাধ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে,” বলেন অধ্যাপক ইফতেখার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং প্রশাসনের ভেতরে দলীয় আনুগত্যের সংস্কৃতি আইন প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করছে। ফলে অপরাধীরা প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে, আর সাধারণ মানুষ হারাচ্ছে আস্থা।
চাঁদাবাজি এখন যেন রাষ্ট্রীয় সঙ্কটের পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা শহর, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও চলছে অবাধ চাঁদা তোলা। পুলিশ, ব্যবসায়ী, ট্রাকচালক—কেউ বাদ নেই।
নওগাঁর ট্রাকচালক রুহুল আমিন বলেন, “এক ট্রাকে মাল তোলার পর গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত অন্তত তিন জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। না দিলে হয় মারধর, নয়তো গাড়ি আটকে দেওয়া।”
এমন চাঁদাবাজির শিকার শুধু পরিবহন খাত নয়, নির্মাণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, এমনকি শিক্ষা খাতও। সাম্প্রতিক সময়ে গুলশানে “সমন্বয়ক” পরিচয়ে একদল তরুণ মব তৈরি করে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা করলে পুলিশি অভিযানে ধরা পড়ে। গ্রেপ্তার হয় আসাদুর রহমান আকাশ ও তাঁর দুই সহযোগী। যৌথ বাহিনীর প্রতিবেদন অনুযায়ী, তারা দীর্ঘদিন ধরে ভীতি সৃষ্টি করে চাঁদা আদায় ও মিথ্যা মামলা বাণিজ্যে জড়িত ছিল।
নরসিংদীতে চাঁদাবাজদের হামলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন গুরুতর আহত হন। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। ঘটনায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তবে স্থানীয় সূত্র জানায়, মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
দেশজুড়ে চাঁদাবাজির প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ সদর দপ্তরে সম্প্রতি জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার ও সব রেঞ্জের ডিআইজিকে কঠোর নির্দেশনা দেন—“চাঁদাবাজদের দল-মত নির্বিশেষে গ্রেপ্তার করতে হবে। কেউ বাদ যাবে না।”
আইজিপি বলেন, “অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। আমরা পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করব, যদি ভুক্তভোগীরা ভয়ে অভিযোগ করতে না পারেন।”
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, বিশেষ অভিযানে শুধু গত এক মাসে ৬৫০ জন চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই নতুন মুখ, যারা ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সক্রিয় হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, “চাঁদাবাজি এখন শুধু অপরাধ নয়, এটি অর্থনৈতিক সমস্যা। এর কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি, তবে সামাজিক সহযোগিতা ছাড়া এটি নির্মূল করা কঠিন।”
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশে চাঁদাবাজি বহুগুণে বেড়েছে। এক টাকা চাঁদা যেখানে আগে নেওয়া হতো, এখন তা দেড় বা দুই টাকা।” তাঁর মতে, “রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ছাড়া চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনীতি ও নিরাপত্তা দুটোই ভেঙে পড়বে।”
অপরাধের পরিসর শুধু চাঁদাবাজিতেই সীমাবদ্ধ নয়। সাম্প্রতিক সময়ে সারাদেশে হত্যা, ডাকাতি, ধর্ষণ ও মব সন্ত্রাসের ঘটনাও বেড়েছে।
গত শুক্রবার বাগেরহাটে সাংবাদিক হায়াত উদ্দিনকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। টাঙ্গাইল মহাসড়কে প্রাইভেটকার থামিয়ে দুর্ধর্ষ ডাকাতি হয়, গাজীপুরে এক বাড়িতে হামলা করে মালপত্র লুট হয়। রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় এক নারীকে কুপিয়ে হত্যা, ধানমণ্ডিতে অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার, খুলনায় তরুণকে গুলি করে হত্যা—সব মিলিয়ে দেশে নিরাপত্তাহীনতা এখন চরমে।
মানবাধিকার সংগঠন এমএসএফ-এর সেপ্টেম্বর মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু এক মাসেই দেশে ২৪ জন গণপিটুনিতে নিহত, ৫২টি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার এবং ৫৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ৮৩ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে—যা আগের মাসের তুলনায় ৮ জন বেশি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “সামাজিক অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা ও নৈতিক স্খলনের কারণে অপরাধ বাড়ছে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি আমাদের সমাজের নৈতিক কাঠামোকে পুনর্গঠিত করতে হবে।”
তিনি স্বীকার করেন, অপরাধ দমনে পুলিশের অভিযান চলছে, তবে এটি কেবল সাময়িক সমাধান। “সমাজে নৈতিক জাগরণ না এলে, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে ভারসাম্য না এলে অপরাধ কমবে না।”
দেশজুড়ে অপরাধ ও চাঁদাবাজির এমন বিস্তার প্রশাসনিক দুর্বলতার পাশাপাশি সামাজিক নৈতিকতার অবক্ষয়কেও নগ্নভাবে প্রকাশ করছে। প্রতিদিনের খবরে নতুন হত্যাকাণ্ড, নতুন ধর্ষণ, নতুন চাঁদাবাজির গল্প। মানুষ আজ ভয়ে বাড়ির বাইরে যায়, পুলিশও আক্রমণের শিকার হয়, আর অপরাধীরা হাসে আইনের চোখে চোখ রেখে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র পুলিশি অভিযান দিয়ে সমাধান করা যাবে না—প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ, দ্রুত বিচার ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
যদি এখনই উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তবে আইন-শৃঙ্খলার বর্তমান চিত্র আগামী দিনে আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করবে—যেখানে মানুষ নিরাপত্তার চেয়ে ভয়ের সঙ্গে বাঁচাকে সহজ মনে করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ